. কাগজের ফুল, জীবনের ভুল
. —রফিক আতা—
বারান্দার কোণে আমি নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছি। বাইরে হেমন্তের হাহাকার—ভোরের ললাটে কুয়াশার পদচিহ্ন, আর থেমে থেমে শীতল বাতাস এসে লোমকূপে আঘাত হেনে যাচ্ছে। কোন এক কালের শতাব্দীপ্রাচীন কল্পনা হঠাৎ মনে ভিড় করে, আমাকে অদ্ভুত উদাসীনতায় নিমজ্জিত করে দেয়। এমনই এক মুহূর্তে জীবনের প্রতি আমি যেন চরম অনাগ্রহ অনুভব করি। ঠিক তখনই মনে পড়ে কাগজে বানানো একটি ফুলের কথা।
অন্যুন সাত বছর আগের কথা। আমাদের মাদ্রাসায় আরিফিন নামের এক ছেলে ছিল, যে কাগজ দিয়ে অনিন্দ্য সৌন্দর্যের ফুল বানাতে পারত। তার হাতের কারুকার্য দেখে মুগ্ধ হয়ে আমিও শিখে নিলাম কাগজের ফুল তৈরির কৌশল। বাড়ি ফিরে কৈশোরের সেই চঞ্চল, ছটফটে বিকেলে সিদ্ধান্ত নিলাম—আমি নিজেও একটি ফুল বানাবো। রঙিন কাগজ, আটা আর কেঁচি ছন্দময় তাড়াহুড়োর মাঝে বাজার থেকে কিনে আনলাম। শুরু হলো কাগজের প্রথম ফুল বানানোর সাধনা।
তিন-চার দিনের অগুনতি মেহনতের পর যখন একটি নান্দনিক ফুল তৈরি হলো, তখনকার অবুঝ কৈশোরে যে আনন্দ পেলাম—তা বর্ণনাতীত। মনে হলো যেন বাঁধ ভেঙে সুখের এক স্রোত বয়ে যাবে ঘরের ভেতর। আমাদের ঘর আর বারান্দার মাঝের যে বেতের তৈরি পার্টিশন, তার ওপর ফুলটি সাজিয়ে রাখলাম। হঠাৎই ঘরটা অমাপিক সৌন্দর্যে ঝলমলে হয়ে উঠল। নিজের হাতে বানানো সেই ফুলের সঙ্গে তখন এক অদ্ভুত আত্মিক বন্ধন তৈরি হয়েছিল—যেন সে শুধু একটি ফুল নয়, বরং আমার কিশোর-মনোজগতের নীরব সাক্ষী।
এরপর ধীরে ধীরে সময় তার আপন ছন্দে এগিয়ে চলল। আমিও শৈশব-কৈশোর ভুলে জীবনের গল্পে জড়িয়ে পড়লাম। বহুদিন পর আজ হঠাৎ সেই কাগজের ফুলটির কথা মনে পড়ল। দেয়ালের দিকে তাকালাম—ফুলটি নেই। ঘরের মেঝেতে চোখ যেতেই দেখি, ধূলোমলিন হয়ে কাগজের ফুলটি পড়ে আছে। আশ্চর্য, একসময় যাকে এত ভালোবাসতাম—আজ সেই ফুলকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখেও মনে কোনো আলোড়ন জাগল না। কারণ খুঁজেও পেলাম না।
শেষমেশ অনিচ্ছাসত্ত্বেও কাছে গেলাম। হাতে তুলে নিলাম ফুলটি। ঠিক তখনই যেন ক্ষীণ, কাঁপা কাঁপা একটি আওয়াজ ভেসে এলো—ফুলটাই কথা বলছে।
— “রফিক আতা, আপনি বদলে গেছেন। বয়স আপনাকে বড় করেছে, কিন্তু সেই ছোট্ট ছেলেটি—যে সৌন্দর্যের প্রতি নীরব বিস্ময়ে ভরে যেত—সে আর আপনার ভেতরে নেই। আমি যখন মাটিতে পড়ে ছিলাম আর আপনার মনে কোনও ঢেউ তুলতে পারলাম না, তখনই বুঝলাম… আপনি আপনার কোমল সত্তাটিকে হারিয়ে ফেলেছেন।”
ফুলটি নিঃশব্দে শ্বাস নিয়ে আবার বলল—
— “আমাকে তুলে নিলেন কি নিলেন না—তা আমার হিসাব নয়। কিন্তু আপনাকে একটি কথা মনে করিয়ে দিতে চাই… মানুষের ভেতরে যদি সেই শিশুমন না থাকে, সেই মুগ্ধতার শিল্পী না থাকে—তাহলে জীবনের কোন ফুলই তাকে আর আনন্দ দিতে পারে না। আমি তো কাগজের ফুল—ক্ষয়ে যাব, ভেঙে যাব। কিন্তু আপনার ভেতরের যে নির্মল মানুষটি ছিল, তাকে ফিরিয়ে আনুন। আবার জাগিয়ে তুলুন সেই হৃদয়ের ছেলেটিকে, যে বিন্দু-সৌন্দর্যেও মহিমা দেখত।”
উপসংহার—
আমি কিছুক্ষণ নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলাম। হাতে ধরা কাগজের ফুলটি ভেঙে পড়ছিল, কিন্তু তার কথাগুলো ছিল ধারালো ও নির্মম সত্যের মতো। সেদিন বুঝলাম—সময় শুধু মানুষকে বড় করে না, কখনো কখনো ভেতরটাকে শুষে নেয়। আর সে শূন্যতা পূরণ করতে হয় নিজের অতীতকে আগলে রেখে।
ফুলটি নষ্ট ছিল, কিন্তু তার বাণী আমাকে নতুন করে গড়ে তুলল।
হঠাৎ অনুভব করলাম—আমার ভেতরেই যেন আরেকটি ফুল ফুটে উঠছে।
অদৃশ্য, কিন্তু সত্য।
নিস্তব্ধ, কিন্তু দীপ্ত।
রচনাকাল—
চৌদ্দ, এগারো, পঁচিশ
শুক্রবার,