. রহস্যময় অতীত ও স্বপ্নময় প্রভাত
. 🖊️—রফিক আতা—
অতীতের কিছু স্মৃতি আজও আমার সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত। কিছু আনন্দের, কিছু দুঃখের, আর কিছু বিষাক্ত—যেমন বেজে ওঠা কাঁটার সুর। সুখ-দুঃখ মিলেমিশে হারিয়ে যায় বিস্মৃতির স্রোতে, কিন্তু বিষাদরা রয়ে যায়, জেগে থাকা কাঁটার মতো, যা ছোঁয়ায় ব্যথা দেয়। আমি চেষ্টা করি লুকাতে, অজানার দেয়ালের রঙে, কিংবা গোলাপের নরম পাপড়িতে। তবু মনে হয়, সেখানে ওরা আমাকে খুঁজে বের করবে, শান্তি এনে দিবে না। আমি চাই ভুলতে, তপস্যার মতো ভুলতে, সেই অতীত যেটা বারবার আমার মনকে রক্তাক্ত করে।
বসন্তের মতো নতুনত্ব আসুক আমার জীবনে। যেখানে আলো ঘেরা থাকবে গোলাপের দল, থাকবে কোমল স্পর্শ, মুক্তছন্দের ঋদ্ধতা। সেখানে থাকবে না কোনো অবাধ্য স্মৃতি, থাকবে না উপহাসের কাঁটা। আমি চাই না বিষাক্ত অতীত আমাকে আহত করুক।
কিন্তু রাতের অন্ধকারে, ঘুম ভেঙে বারবার ফিরে আসে অভিশপ্ত দৃশ্য। কলমে ঝরে পড়ে অভিযোগের শব্দ। দূরের রেললাইনের হর্ণে থমকে যায় স্বপ্ন। প্রশ্ন ঘুরপাক খায়—আমি কি বেঁচে থাকতে পারব এই অদৃশ্য পিছু ধাওয়া থেকে? শতাব্দী জুড়ে কি মুছে যাবে না এই ছায়া? কখনো ভাবি, যদি আমি সন্ত্রাস হতাম, ত্রাস ছড়িয়ে দিতাম অভিশপ্ত স্মৃতির রাজ্যে; যদি আমি আজরাইল হতাম, কবজ করে নিতাম তাদের রুহ ; যদি আমি ইসরাফিল হতাম, এক শিঙ্গার ফুঁতেই ভেঙে যেত অভিশপ্ত স্মৃতির রাজ্য। কিন্তু হায়! আমি কিছুই নই—শুধু এক অসহায় মানুষ।
রাত প্রায় শেষ দিগন্তে। একটু পরেই আধারের আধিপত্য শেষ হবে। উন্মোচিত হবে প্রভাতের স্নিগ্ধতা। কিয়ামুল লাইলের মধুর সাইরেন বেজে উঠলো সমগ্র মুসলিম জাহানে। অদৃশ্য কাগজ কলমের সখেদ বুলি স্বপ্নের স্কন্ধে ঝুলিয়ে দপ করে বসে পড়লাম শোয়া থেকে। লক্ষ করলাম কয়েকটি শুভ্র পোশাকাবৃত সত্তা সালাত ও মুনাজাতে নিমগ্ন। সারাটা কামরায় মিহি মিহি কান্নার হৃদয়স্পর্শী থমথমে সুর। তাপ ও অনুতাপ এবং আশা ও প্রত্যাশার অশ্রু যাদের দু চোয়ালে। যারা ডুবে আছে প্রভু প্রেমের অতল ও অথৈ সমুদ্রে। যারা ...تتجافى جنوبهم عن المضاجع এর সরল নিখুঁত ও নিরেট মেসদাক।
সেই দৃশ্য দেখে আমিও ছুটলাম।
সচ্ছ পানির শীতল স্পর্শে দ্রুত অযু সেরে এসে নামাযে দাঁড়ালাম। শরীক হলাম সেই সকল শুভ্র সত্তার সুন্দর সারিতে। কিয়ামুল লাইলান্তে হাত উত্তলন করলাম তার রহমতের গুপ্ত ও ব্যাপ্ত ভান্ডারে। আদ্রতার স্পর্শে বুঝতে পারলাম আমি কাঁদছি। এবং কাঁদছি অঝোর ধারায়। যেন শ্রাবণের ঋতুতে হঠাৎ করে ঋদ্ধতার আগমন।
হৃদয়ে ধ্বনিত হলো আক্ষেপের প্রার্থনা—
"رب انى مغلوب فانتصر"— হে প্রভু, আমি পরাজিত, তাই সাহায্য করুন।
কতক স্মৃতির স্মরণ আজ আমার জন্য পাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেসব ভুলিয়ে দিন, মুছে দিন অমীমাংসিত দহন।
ফজরের আলো ধীরে আসল। কামরায় ফিরে এলাম। বাইরে তখন বৃষ্টি, বাতাস মুখরিত। প্রকৃতি শীতল, মনও তুলনামূলক প্রশান্ত। স্বস্তির খোঁজে হাতে নিলাম কুরআনুল কারীম। বুকের কাছে টেনে নিতেই চোখ পড়ল এক চিরন্তন আয়াতে—
"قُلْ يَا عِبَادِيَ ٱلَّذِينَ أَسْرَفُوا۟ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا۟ مِن رَّحْمَةِ ٱللَّهِ ۚ"
অর্থ: বলুন, হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজেদের উপর সীমা অতিক্রম করেছো! তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন। তিনি তো অতিশয় ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সুরা যুমার, আয়াত ৫৩)
প্রতিধ্বনির মতো বাজতে লাগলো সেই বার্তা—
"لَا تَقْنطُوا۟ مِن رَّحْمَةِ ٱللَّهِ"—তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না।
আজকের ফজর হয়ে উঠলো এক অনন্য আহ্বান। প্রশান্তির আবির মেখে ভোরের আকাশ যেন নতুন জীবন গড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিল। মনে হলো—একটি অমীমাংসিত স্মৃতির রহস্য আজ উন্মোচিত হলো। একটি নির্মল প্রভাত ভেসে এলো হৃদয়ে, শিশিরভেজা শান্তির মতো। চোখে ভেসে উঠল অদৃশ্য হাসি, বাতাসে মিশে গেল ক্ষুধার্ত বিষাদের চিহ্ন। অতীত ও বর্তমান যেন এক হয়ে গেলো, এবং আমি শিখলাম—যে অতীতের ছায়া যত গভীর, তার মধ্যেও রহস্যময় প্রভাতের আলো আছে।
শান্তি আসে, যখন হৃদয় বিশ্বাস করে, অতীতকে ক্ষমা করতে। আর সেই বিশ্বাসের মধ্যেই জন্ম নেয় নতুন জীবন, যেখানে বিষাক্ত স্মৃতি আর ক্ষমতার ছায়া আর আমার উপর চাপ সৃষ্টি করে না। আমি জানি—আজ থেকে, আমার প্রতিটি ফজর, প্রতিটি প্রভাত, হবে সেই অমীমাংসিত স্মৃতিকে স্নান করানো, তাকে চিরতরে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান।
দিনলিপি
৯।৭।২০২৫ইং
ধারা-মুক্তগদ্য