শীতের দিনে
মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন
বিশ্লেষণধর্মী
। ডিসেম্বর ২৬,২০২৫
শীতের সঙ্গে ঈদের একটা অদ্ভুত মিল আছে।
মানুষ ছাড়া যেমন ঈদ হয় না, তেমনি মানুষ ছাড়া শীতও হয় না। মানুষহীন শীত শুধু ঠান্ডা নিয়ে আসে, উষ্ণতাটা আর থাকে না।
আরামের বদলে শীত তখন হয়ে ওঠে এক বৃদ্ধ যার বরফ নাম। ভয়ংকর সকাল, ম্যাড়মেড়ে দুপুর, নিঃসঙ্গ সন্ধ্যা—কিন্তু সেই সন্ধ্যার পরে কোনো উষ্ণতা নেই।
ছোটবেলায় পিঠা বানানোর দিনগুলোকে মনে হতো ঈদের দিন। বিকেল থেকেই শুরু হতো এন্তেজাম। যৌথ পরিবারের পিঠা বানানোর সেই দৃশ্য যে দেখেনি, তাকে বোঝানো মুশকিল। আম্মুরা যতই চেষ্টা করুক, দাদির মন কিছুতেই ভরতো না।
ওদিকে প্রথম পিঠা নিয়ে লাগতো মারামারি।
ডিসেম্বরের রাতগুলো ছিল অসম্ভব সুন্দর। পরীক্ষা না থাকার জন্য নয়—গল্পের জন্য। বাড়িভর্তি মানুষ, ঝুড়িভর্তি গল্প। এর মধ্যে ভূতের সেগমেন্ট ছিল সবচেয়ে ভয়ের আর মজার। কুয়াশার মধ্যে সাদা অবয়ব কল্পনা করে ভয় পাওয়ার যে আনন্দ—সেটা কোনো অংশে কম ছিল?
অথচ এখন পরীক্ষা না থাকলেও, পড়াশোনার চাপ না থাকলেও ডিসেম্বরের রাত আর আলাদা লাগে না।
কারণ শীত আগের মতো থাকলেও মানুষগুলো হারিয়ে গেছে। শীতের রাতে গোল হয়ে বসে গল্প করা হয় না। ভূতের ভয়টাও আর পাওয়া যায় না।
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর শীত আর উপভোগ করা যায় না। এখন আমরা শীত যাপন করি মাত্র।
ছোটবেলার শীত আমাদের এত প্রিয় ছিল কেন?
ছুটির জন্য? তিন গোয়েন্দার বইয়ের জন্য? পিঠার জন্য?
রেস্টুরেন্ট থেকে কিনে খাওয়া পিঠায় মিষ্টি যতই থাকুক, সেই আরামটা থাকে না, উৎসবটা থাকে না। ফলে আজকাল শুধু পিঠা খাওয়াই হয়, পিঠা বানানোর সেই ঈদ আর দেখা হয় না।
গৃহহীন মানুষের কাছে শীত আস্ত এক জাহান্নাম। আক্ষরিক অর্থেও সত্যি, মেটাফরিক অর্থেও সত্যি। একবার বাড়ি ছেড়ে চলে আসুন—তারপর যত রুম হিটার দিন, যত লেপ-কম্বল নিন, অন্তরটা ঠান্ডাই থেকে যাবে।
বাড়ি থেকে দূরে থাকা ব্যস্ত মানুষের কাছে শীত তাই একটা ক্লান্তিকর নস্টালজিয়ার ভারী চাদর ছাড়া কিছু নয়।
যে ডিসেম্বর ছোটবেলায় আমাদের কাছে এত প্রিয় ছিল, বড় হয়ে সেই ডিসেম্বরকেই ভয় পেতে হয়। তার সন্ধ্যাগুলো সিন্দাবাদের ভূতের মতো ঘাড়ে চেপে বসে।
আগে কেউ বলত, “ঈদের দিন ঘুমাতে ভালো লাগে”—অবাক লাগতো। পরে বুঝলাম, সমস্যা ঈদে নয়, ঘুমেও নয়। সমস্যা মানুষে। যার কাছে ঈদ উদ্যাপন করার মতো মানুষ নেই, সে না ঘুমিয়ে করবে কী?
শীতের সন্ধ্যাগুলোও ঠিক তেমন।
ছোটবেলার শীত আমাদের এত প্রিয় ছিল মূলত মানুষের জন্য।
শীতের সন্ধ্যা মানেই ভরপুর মানুষ। ভাই-বোন সবার পরীক্ষা শেষ। বাড়িতে বসে যেত ভাই-বোনের মেলা। সকালে খেজুরের রস দিয়ে শুরু, বিকেলে পিঠার মহাযজ্ঞ।
পরিবার-পরিবেষ্টিত শীত যেখানে আদর, ভালোবাসা আর উৎসবের চাদর নিয়ে আসে—একাকী মানুষের শীতে শুধু নিঃসঙ্গতা ডেকে আনে।
একের পর এক নস্টালজিয়ায় দীর্ঘ রাতগুলো আরও দীর্ঘ হয়ে যায়। একসঙ্গে না খাওয়া দু’কাপ চায়ের কথা মনে পড়ে, মায়ের চাদরের কথা মনে পড়ে, ভাই-বোনের বড় হয়ে যাওয়ার কথা মনে পড়ে।
শীত তাই একেকজনের কাছে একেক রকম হয়ে ধরা দেয়।
যখন দেখি, শীতের মতো চমৎকার একটা ঋতুকেও অনেকে অপছন্দ করে—আমার আর অবাক লাগে না। বরং মায়া লাগে।
কারণ পৃথিবীটা আসলে ফেয়ার নয়।
শীত সবার জন্য শুষ্ক, কঠিন ঠান্ডা ঠিকই নিয়ে আসে, কিন্তু সবাইকে ভালো রাখার মতো যথেষ্ট উষ্ণতার চাদর নিয়ে আসে না। এর চেয়ে নির্মম সত্য এই পৃথিবীতে আর একটাও নেই।
#শীতেরদিনে #নস্টালজিয়া #ছোটবেলারশীত #পিঠাপুলি #পরিবার #ডিসেম্বর #উষ্ণতা #নিঃসঙ্গতা #স্মৃতি #শীতেররাত