একজন ভালো বাবা হওয়ার আগে ভালো স্বামী হওয়া জরুরি
মোহাম্মদ জাহিদ হোসন
বিশ্লেষণধর্মী। ডিসেম্বর ২৬, ২০২৫
প্রতিটি মেয়ের বাবা তার মেয়েকে দিয়ে বুঝতে পারেন, তিনি নিজের স্ত্রীর সঙ্গে কী করেছেন আর কী করা উচিত ছিল...
আজ সকালে খবরের কাগজ পড়ছিলাম। আমার আড়াই বছরের ছোট্ট মেয়েটা বারান্দায় গাছের পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে তার খেলনার হাঁড়িপাতিলে «রান্না» করছে। হঠাৎ ভ্রূ কুঁচকে দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করল,
«বাবা, চা খাবে?»
চা খাওয়ার এই বদভ্যাসটা আমার বেশ পুরোনো। আমি তার খেলনার ছোট্ট বাটিতে মুখ ডুবিয়ে এক চুমুক দিয়ে তৃপ্তির সঙ্গে বললাম,
«খুব ভালো হয়েছে, মা।»
সে আবার জিজ্ঞেস করল,
«আর এক কাপ খাবে?»
«না মা, বাবা এখন পড়াশোনা করছে।»
«তাহলে নিডো খাও! শক্তি হবে!»
আমি তার দিকে তাকালাম। আমাকে নিয়ে এমন চিন্তিত চেহারা আমার গর্ভধারিণী মায়ের পর আর কাউকে দেখিনি। হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নিলাম। সে আমার ঘাড়ে মাথা রেখে চুপ করে শুয়ে রইল। তার মাথার ঘ্রাণে আমার চোখ ভিজে উঠল। আহা, মা! আহা, এই বন্ধন! মাঝেমাঝেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। সব কন্যাসন্তানের বাবাই বোধ হয় এভাবে আবেগ লুকিয়ে কাঁদেন।
বিয়ের দিন বিদায়ের মুহূর্তে আমার শ্বশুর মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কেঁদেছিলেন। আমার হাত শক্ত করে ধরে বলেছিলেন,
«মেয়েটা আমার খুব আদরের। ও কোনো ভুল করলে আমাকে বলো বাবা, বকাঝকা করো না।»
তেজি ঘোড়ার মতো পাগড়ি নাচিয়ে আমি সুবোধ বালকের মতো বলেছিলাম,
«অবশ্যই, বাবা।»
কথা রাখিনি।
সংসারের চড়াই-উতরাইয়ে আরেকজনের কন্যাকে কাঁদাই, বকাঝকা করি, পুরুষত্বের অহংকার দেখাই। আমার স্ত্রী আজ আমাদের সংসার নিয়েই চিন্তিত। বাবার বৃত্ত ছেড়ে সে গড়ে তুলেছে নতুন বৃত্ত—যার কেন্দ্রে শুধু আমাদের সন্তান আর এই বদমেজাজি আমি। একজন নারী তার সংসারের জন্য কতটা ত্যাগ স্বীকার করে, সেটা কখনো পুরোপুরি বোঝা যায় না।
আমার ছোট্ট মেয়েটাও একদিন হাউমাউ করে কাঁদিয়ে আরেকজনের হাত ধরে চলে যাবে। তখন আমাকেও হয়তো একই কথা বলতে হবে কোনো যুবকের হাতে। আমি চাই না আমার ব্যর্থতা আমার কন্যাকে স্পর্শ করুক। আমি ক্ষমাপ্রার্থী—কথা রাখতে না পারার জন্য অনুতপ্ত।
কন্যার বাবা হওয়া খুব কষ্টের। কতটা কষ্টের, সেটা কন্যাসন্তান জন্মানোর আগে বোঝা যায় না। চোখের কোণায় পানি জমে আসছে...
এদিকে আমার ছোট্ট মেয়েটা অস্থির হয়ে উঠেছে। ভ্রূ কুঁচকে আমার কোলে উঠে এসেছে যেন এক অপরাধীর জবানবন্দি পড়ার চেষ্টা করছে। তার চোখেও জল। কী জানি—মেয়েরাই বোধ হয় বাবার অনুভূতি পড়তে পারে। আল্লাহ মেয়েদের এই অদ্ভুত শক্তি দিয়েই পৃথিবীতে পাঠান।
একজন বাবা তার সন্তানের কাছে কেমন, তা নির্ভর করে তিনি স্বামী হিসেবে স্ত্রীর সঙ্গে কেমন আচরণ করছেন তার ওপর। সন্তানেরা মায়ের চোখ দিয়েই বাবাকে দেখে।
যদি স্ত্রী স্বামীকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে—সন্তানেরাও বাবাকে ভালোবাসতে ও শ্রদ্ধা করতে শেখে।
যদি স্ত্রী স্বামীকে ঘৃণা করে—সন্তানেরাও সারা জীবন বাবাকে ঘৃণার চোখে দেখে।
একজন বাবার মূল্যায়ন তার নিজের কাজ দিয়ে হয় না। বরং মা কীভাবে বাবাকে সন্তানের সামনে উপস্থাপন করেন, সেই আলোতেই নির্ধারিত হয়। সন্তানেরা মায়ের চোখ দিয়েই বোঝে—বাবা হিরো, নাকি ভিলেন।
তাই, একজন ভালো বাবা হওয়ার আগে একজন ভালো স্বামী হওয়া খুবই জরুরি।
বেলা শেষে সবার টনক নড়ে—তার আগে নয়।
#ভালোস্বামী #ভালোবাবা #কন্যাসন্তান #বাবারঅনুভূতি #সংসার #পিতৃত্ব #মেয়েরবাবা #পরিবার #ভালোবাসা #আবেগ