অন্ধবিশ্বাস ও অমানবিকতা
মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন
বিশ্লেষণধর্মী। ডিসেম্বর ২৬,২০২৫
বিঃদ্রঃ
@Nargis Parvin এর
"অন্ধবিশ্বাস মনুষ্যত্বের অন্তরায়।
যুক্তিহীন বিশ্বাস মানুষকে অমানুষ করে তোলে।" এ লাইনদুটির বিশ্লেষণ।
শুরুতেই একটা সরল প্রশ্ন—সবচেয়ে ভয়ংকর মানুষ কাকে বলবেন?
যার হাতে অস্ত্র আছে?
না, আসল ভয় তো তখনই, যখন কারও হাতে অন্ধবিশ্বাস, আর মাথার ভেতর প্রশ্নহীন আনুগত্য।
অন্ধবিশ্বাসকে অনেকেই ছোটখাটো বা ব্যক্তিগত কিছু ভাবে, কিন্তু আসলে এটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক। কারণ, এখানে মানুষ নিজের বিবেক আর যুক্তি কাউকে গিয়ে দিয়ে আসে। সেই মুহূর্ত থেকেই, ধীরে ধীরে মানুষ তার মানবিকতা হারাতে থাকে।
ইতিহাসে তাকান—সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা, নিষ্ঠুরতা, গণহত্যা—এসব কি যুক্তি দিয়ে হয়েছে? একেবারেই না। “এটাই ঠিক”, “ওই লোকটা বলেছে, মানতেই হবে”, “প্রশ্ন করলে পাপ হবে”—এইসব কথাগুলোর আড়ালে মানুষ খুনকে ন্যায্য মনে করেছে, নির্যাতনকে দায়িত্ব বলে মেনেছে।
সবচেয়ে বড় বিপদ—অন্ধবিশ্বাস মানুষের ভাবনা থামিয়ে দেয়। মানুষ আর প্রশ্ন করে না। যে সমাজে প্রশ্ন বন্ধ হয়ে যায়, সেখানেই অন্যায় মাথা তোলে। কারণ, অন্যায় বেঁচে থাকে নীরবতার ওপর ভর করে।
প্রায়ই দেখবেন, কোনো গুজব ছড়িয়ে পড়ে—“শুনেছি”, “বলছে”, “ফেসবুকে দেখলাম”—কেউ যাচাই করে না, সোজাসুজি বিশ্বাস করে। তারপর সেই বিশ্বাস থেকেই জন্ম নেয় ঘৃণা, হিংসা, মারামারি। তখন মানুষ আর নিজের মত ভাবতে পারে না, দলবদ্ধ উত্তেজনায় গা ভাসিয়ে দেয়। কেউ ভাবে না, “আমি কী করছি?”
কেন অন্ধবিশ্বাস মানুষকে অমানুষ বানায়, তার কারণ খুব সহজ। যুক্তি মানুষকে থামায়, ভাবতে শেখায়, অন্যের জায়গায় গিয়ে বুঝতে শেখায়। অন্ধবিশ্বাস এগুলো চায় না। সে শুধু বলে—“ভাবার দরকার নেই, মানো।”
এই “শুধু মানো”—সবচেয়ে ভয়ংকর কথা।
মানুষ যখন শুধু মানতে শেখে, তখন অন্যের কষ্ট দেখেও মুখ ফিরিয়ে নেয়। তখন বলে—“আমার কিছু করার নেই।” তখন শুধু উপরের কথা-ই ঠিক—এই ঠিকানায় দাঁড়িয়ে জন্ম নেয় নিষ্ঠুরতা, বৈষম্য, অমানবিকতা।
অন্ধবিশ্বাস ধর্মীয় হতে পারে, রাজনৈতিক হতে পারে, নেতার নামে, এমনকি পরিবারের নিয়মেও। আসল কথা, আপনি যা-ই বিশ্বাস করেন, সেখানে প্রশ্ন করার জায়গা আছে তো?
যে বিশ্বাস প্রশ্ন মেনে নিতে পারে না, সেটা মানুষের জন্য সত্যি বিপজ্জনক।
অনেকে বলেন, “বিশ্বাস থাকলে শান্তি আসে।” অর্ধেক ঠিক। বিশ্বাসে শান্তি আসবে, যদি সেখানে যুক্তি থাকে। না হলে সেই বিশ্বাসই একদিন আতঙ্ক হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, যুক্তিহীন বিশ্বাস মানুষকে নিজের বিবেকের বিরুদ্ধে দাঁড় করায়।
আমরা সবাই এমন কাউকে চিনি, যে নিজের চোখে অন্যায় দেখেও বলে—“এটা ঠিকই তো আছে।” কেন? কারণ, তার বিশ্বাস প্রশ্ন করতে শেখায়নি। যেদিন মানুষ নিজের চোখের সামনে অন্যায় দেখেও চুপ থাকে, সেদিন সে আর মানুষ থাকে না—হয়ে যায় অন্ধবিশ্বাসের যন্ত্র।
অন্ধবিশ্বাস মনুষ্যত্বের অন্তরায়—এটা শুধু নৈতিক শিক্ষা না, বাস্তব সতর্কতা। মনুষ্যত্ব মানে সহানুভূতি, বিবেক, ন্যায়বোধ—এগুলো প্রশ্ন করার ক্ষমতার ওপর দাঁড়িয়ে। “কেন” বলতে না পারলে, মানবিকতাও আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায়।
সবচেয়ে ভয়ংকর অন্ধবিশ্বাস—“আমি ঠিক, তুমি ভুল।” এখান থেকেই মানুষ মানুষকে শত্রু ভাবতে শেখে, বিভাজন শুরু হয়, পরিচয়, মত, দল—এসবের বাইরে মানুষকে আর মানুষ মনে হয় না। এখান থেকেই অমানবিকতা তৈরি হয়।
এই লেখা কাউকে বিশ্বাস ভাঙতে বলছে না, বলছে অন্ধবিশ্বাস ভাঙতে। বিশ্বাস রাখুন, কিন্তু চোখ খোলা রাখুন। মানুন, কিন্তু মাথা নিচু করে না। প্রশ্ন করুন—কারণ, প্রশ্ন করা মানে অবাধ্যতা না, বরং এটাই মানুষ হওয়ার প্রথম শর্ত।
আজ আমাদের দরকার বেশি বিশ্বাসী না, দরকার বেশি সচেতন মানুষ। যারা যাচাই করবে, ভাববে, বুঝবে। যারা হাসিমুখে বলবে—“এক মিনিট, এটা কি ঠিক?” এই ছোট্ট প্রশ্নটাই কাউকে মারার হাত থেকে কাউকে বাঁচাতে পারে।
শেষ কথা—আপনি কী হবেন?
প্রশ্নহীন বিশ্বাসী, নাকি বিবেকবান মানুষ?
ইতিহাস দেখিয়েছে, অন্ধবিশ্বাস আলোর পথ দেখায় না, বারবার মানুষকে অন্ধকারেই ঠেলে দেয়।
এই লেখাটা যদি আপনার ভেতর কোনো প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে, তাহলে চুপ থাকবেন না। যুক্তির পক্ষে দাঁড়ান, মানবিকতার পাশে থাকুন—শেয়ার করুন।
#অন্ধবিশ্বাস #যুক্তির_পক্ষে #মনুষ্যত্ব
#প্রশ্ন_করুন #মানবিকতা #সচেতনতা
#BanglaThoughts