কালান্তরের শপথ ; স্বাধীনতা, চেতনা ও ভবিষ্যতের বাংলাদেশ
-----------------------------
প্রস্তাবনা: গৌরবোজ্জ্বল বিজয়ের মহিমা
১৬ই ডিসেম্বর— বাঙালি জাতির জীবনে শুধু একটি তারিখ নয়, এটি আত্মমর্যাদা, সংগ্রাম ও চূড়ান্ত আত্মজয়ের প্রতীক। আজ থেকে ৫৪ বছর আগে এই দিনে পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নিয়েছিল একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, যার নাম বাংলাদেশ। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ এবং ৩০ লক্ষ শহীদের জীবন ও ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাঙালি জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করেছিল। মহান বিজয় দিবস তাই কেবল আনন্দ উৎসবের দিন নয়, এটি আমাদের জাতীয় জীবনের সকল অর্জনের মূল ভিত্তি, এক প্রেরণার উৎস। এই প্রবন্ধে আমরা স্বাধীনতার পটভূমি, মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা এবং আধুনিক বাংলাদেশ নির্মাণে এর তাৎপর্য বিশ্লেষণ করব।
স্বাধীনতার পটভূমি ও জাতিসত্তার জাগরণ
১৯৪৭ সালে ধর্মীয় দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের পর জন্ম নেওয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে বাঙালির মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল শুরু থেকেই। ভৌগোলিক দূরত্ব ছাড়াও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা বাঙালি জাতির উপর চালায় সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নিপীড়ন। বাঙালির আত্মপরিচয়ের উপর প্রথম আঘাত আসে যখন ১৯৫২ সালে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার অধিকার কেড়ে নেওয়ার অপচেষ্টা করা হয়। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালি তার জাতীয়তাবাদের প্রথম বীজটি বপন করে।
পরবর্তীকালে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী নেতৃত্বেই বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়। তিনি বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণা করেন, যা ছিল কার্যত স্বাধীনতার পথে প্রথম সুস্পষ্ট পদক্ষেপ। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় প্রমাণ করে যে বাঙালি তাদের শাসনভার নিজেদের হাতে নিতে প্রস্তুত। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী জনগণের এই রায়কে উপেক্ষা করে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা যখন 'অপারেশন সার্চলাইট'-এর নামে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর গণহত্যা শুরু করে, তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। শুরু হয় আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, মহান মুক্তিযুদ্ধ।
রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের গৌরব
দীর্ঘ নয় মাস ধরে চলেছিল এই জনযুদ্ধ। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক—সমাজের সকল স্তরের মানুষ অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। বীর মুক্তিযোদ্ধারা গঠিত হন মুক্তিবাহিনীতে, যাঁরা শত্রুর বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই চালান। প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের অধীনে দেশের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠে দুর্বার প্রতিরোধ। এই যুদ্ধে আমাদের পাশে ছিল প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের মানবিক ও সামরিক সহায়তা। কিন্তু এই বিজয়ের মূল চালিকাশক্তি ছিল ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত এবং প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে ধারণ করা মুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষা।
অবশেষে, ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এই দিন বিকেলে বাঙালি জাতি তাদের চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে। আকাশে উড়ে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। এই মুহূর্তটি শুধু সামরিক বিজয় নয়, এটি ছিল হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি জাতির নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এক ঐতিহাসিক ক্ষণ।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা: জাতীয় জীবনে যার প্রতিফলন
বিজয় দিবস আমাদের সেই চারটি মূল নীতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল চালিকাশক্তি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের মূল ভিত্তি। এই চেতনাগুলি হলো:
জাতীয়তাবাদ: ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে গঠিত বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠা।
গণতন্ত্র: জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার নির্বাচনের সুযোগ।
ধর্মনিরপেক্ষতা (অসাম্প্রদায়িকতা): রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্মকে ব্যবহার না করা এবং সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করা।
সমাজতন্ত্র (অর্থনৈতিক মুক্তি): শোষণমুক্ত সমাজ এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা।
এই চেতনাগুলোই ছিল একটি স্বাধীন, উন্নত এবং মানবিক রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি। এগুলো আজও আমাদের পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করছে।
তরুণ প্রজন্ম ও ভবিষ্যতের বাংলাদেশ-
স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় পরে, বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিত। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষার প্রসার এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার—প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেশ অভাবনীয় উন্নতি সাধন করেছে।
তবে এখনো সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি দমন এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করা আধুনিক বাংলাদেশের প্রধান লক্ষ্য। এই লক্ষ্য পূরণের মূল দায়িত্ব বর্তায় আজকের তরুণ প্রজন্মের উপর।
তরুণদের উচিত কেবল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের নৈতিক ও আদর্শিক চেতনাকে ধারণ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্পকলা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করা অপরিহার্য। পাশাপাশি, অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শে অবিচল থেকে যেকোনো প্রকার বিভাজন ও উগ্রবাদকে প্রতিহত করার সংকল্প নিতে হবে। তরুণরাই পারে জাতির পিতার ‘সোনার বাংলা’র স্বপ্নকে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবে রূপ দিতে।
অঙ্গীকারের দিন-
মহান বিজয় দিবস আমাদের কেবল স্মৃতিচারণের সুযোগ দেয় না, এটি আমাদের আত্ম-অনুসন্ধান এবং নতুন করে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানায়। যে মূল্যবোধ ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, তাকে সুরক্ষিত রেখে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করাই হোক আমাদের প্রধান অঙ্গীকার।
বিজয় মানেই থমকে যাওয়া নয়, বরং অতীতের গৌরবকে সঙ্গে নিয়ে দুর্বার গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে চলা। আমরা যেন কখনোই ভুলি না—এই বিজয় ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের ঋণ।
সকলকে মহান বিজয় দিবসের আন্তরিক শুভেচ্ছা!