আমরা যখন মেয়েদের ভালোবাসা দেখাতে চাই, তখন খুব সহজে কিছু নাম মুখে চলে আসে। দেবসেনা, অপ্সরী, মেনকা, উর্বশী, রম্ভা, তিলোত্তমা, ঘৃতাচী—এই নামগুলো শুনতে রাজকীয়, শক্তিশালী বা অপার সুন্দর মনে হয়। কেউ বলে, “তুমি তো দেবসেনার মতো শক্ত,” কেউ বলে, “একদম অপ্সরীর মতো সুন্দর,” আবার কেউ মজা করে বলে, “মেনকার মতো নাচ জানো।” আমরা এসব বলি ভালোবাসা থেকে, প্রশংসা করতে গিয়ে। মেয়েরাও খুশি হয়। ভাবে, আমাকে বিশেষ মনে করা হচ্ছে, আমাকে সম্মান দেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু সমস্যাটা শুরু হয় ঠিক এখানেই। আমরা নামগুলো ব্যবহার করি, কিন্তু নামগুলোর পেছনের অর্থ, গল্প, উদ্দেশ্য—সেগুলো নিয়ে ভাবি না। দেবসেনা শুনলে আমরা শুধু শক্তিশালী নারী দেখি, কিন্তু ভুলে যাই এটা পুরাণের যুদ্ধের চরিত্র। অপ্সরী শুনলে শুধু সৌন্দর্য দেখি, কিন্তু জানি না বা ভাবি না যে অপ্সরীরা ছিল নর্তকী, যাদের ব্যবহার করা হতো পুরুষদের মন ভাঙাতে। মেনকা, উর্বশী, রম্ভা—এরা গল্পে শুধু সুন্দরী না, এরা ছিল প্রলোভনের হাতিয়ার। তিলোত্তমা বা ঘৃতাচীর মতো নামগুলোও মোহ, শরীরী আকর্ষণ আর বিভ্রান্তির গল্পে জড়ানো।
আমরা শুধু ভালো অংশটা নিই—“সুন্দর”, “আকর্ষণীয়”, “বিশেষ”—আর বাকিটা চোখ এড়িয়ে যাই। মেয়েরাও জানে না। সে ভাবে, আমাকে কত সুন্দর বলা হলো। কিন্তু একবারও ভাবা হয় না, এই প্রশংসার ভেতরে এমন কিছু আছে কি না, যা আমাদের বিশ্বাস, আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের দ্বীনের সঙ্গে যায় না।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো—আমরা খুব সহজে এসব নাম দিয়ে ডাকি, কিন্তু খুব কমই ডাকি ভালো চরিত্রের উদাহরণ দিয়ে। খুব কমই বলি, তুমি ফাতিমার মতো সম্মানী, মারিয়ামের মতো পবিত্র, খাদিজার মতো দৃঢ়, আয়েশার মতো বুদ্ধিমতী। এই নামগুলোও সুন্দর, কিন্তু এগুলো শুধু চোখের সৌন্দর্য না, ভেতরের সৌন্দর্যের কথা বলে। এগুলো বললে মেয়েকে শুধু খুশি করা হয় না, তাকে সম্মান দেওয়া হয়।
এখন হয়তো অনেকেই বলবেন—“ফাতিমা বা ভালো মানুষের মতো হওয়া কি এত সহজ?”
হয়তো কেউ বলবেন—“ফাতিমা বলে ডাকলে ফাতিমাকেই অসম্মান করা হবে, কারণ সবাই তো আর তাদের মতো হতে পারে না।”
তাদের জন্যই এই কথাটা বলা দরকার।
এটা কাউকে ফাতিমা বানানোর দাবি না। এটা তুলনা করে চাপ দেওয়ার কথাও না। এটা শুধু দিক দেখানোর কথা। যেমন করে অপ্সরী বলা মানে কাউকে নর্তকী বানানো না, তেমনি ফাতিমা বলা মানে কাউকে নবী-কন্যা বানানোও না। নামগুলো এখানে লক্ষ্য না, মূল্যবোধটাই আসল। আমরা কোন দিকে তাকিয়ে প্রশংসা করছি—সেটাই প্রশ্ন।
আমরা আসলে খারাপ চাই না। আমরা পাপ করতে চাই না। কিন্তু না জেনে বলা কথাও দায়িত্বহীনতা। কারণ শব্দ শুধু শব্দ না—শব্দ চিন্তা বানায়, চিন্তা মানসিকতা বানায়, আর মানসিকতা সমাজ বানায়। আজ আমরা যে নামগুলো দিয়ে প্রশংসা করছি, কাল সেগুলোই মেয়েদের ওপর চাপ হয়ে দাঁড়াচ্ছে—শুধু সুন্দর হতে হবে, আকর্ষণীয় হতে হবে।
হয়তো এখন সময় এসেছে একটু সচেতন হওয়ার। কারো প্রশংসা করবো, অবশ্যই করবো। কিন্তু এমন নামে, এমনভাবে, যাতে ভালোবাসার সঙ্গে গুনাহ না জড়ায়, প্রশংসার সঙ্গে ভুল আদর্শ না আসে। নাম যেন শুধু শুনতে সুন্দর না হয়, ভেতর থেকেও পরিষ্কার হয়।
ভালোবাসা মানে শুধু খুশি করা না।
ভালোবাসা মানে সঠিক শব্দ বেছে নেওয়া।
আর সঠিক শব্দই একটা সমাজকে ধীরে ধীরে ঠিক পথে আনে।