বনু কুরাইজা হত্যার ব্যাপারে এক তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
আসসালামু আলাইকুম ওরাহমাতুল্লাহ
একজনের পোস্ট এর জবাব দেওয়ার জন্য এই বিষয়ে লেখাটা লেখলাম। আর এই বিষয়ে ফেসবুকে কোনো লেখা না থাকার কারনে সংক্ষিপ্ত ভাবে কিছু আলোকপাত করা জুরুরি মনে করেই লেখেছি........
তো চলুন শুরু করা যাক।
আমি আমার এই লেখাটাকে কয়েকটা পয়েন্ট এতে বিভক্ত করছি।
পয়েন্ট -১
দাবি : খায়বারের যুদ্ধে ৭-৮০০ মতান্তরে ৯০০ ইহুদিদের হত্যা করে.. "
জবাব : এখানে দুটো বিষয় আছে
১. নং বিষয় : ওটা খায়বাের যুদ্ধ হবে না, বরং আহযাব বা খন্দকের যুদ্ধ হবে! । তিনি মূলত খন্দক আর খাইবারের যুদ্ধকে এক করে ফেলেছে। তার নিজেরই তারীখ, সীরাত এসব ভালো করে পড়া উচিত ছিল তাহলে এমন ভুল তিনি করতেন না। তো মূল কথা হলো এই ঘটনা সংগঠিত হয় খন্দক যুদ্ধক পরে ( রেফারেন্স : সীরাতুর রাসূল -৪১৬ নং পৃষ্ঠা / আর রাহিকুম মাখতুম - ৩৫৭ নং পৃষ্ঠা )
২. নং বিষয় : কতজন হত্যা করা হয়েছিল এই নিয়ে তারীখের ( ইতিহাসের কিতাবে) মতবিরোধ আছে, কিন্তু বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে সেদিন ৪০০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল ( তিরমিজি -১৫৮২)
লিংক -
https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=40374
অর্থাৎ সঠিক মত অনুসারে ৪০০ জন হবে যেহেতু হাদীসে এটাই এসেছে। তাই আমরা ৯০০ জন হত্যা করা হয়েছিল এই মতকে আমরা বাতিল বলে আখ্যায়িত করছি... ।
পয়েন্ট -২
দাবি : এই বনু কুরাইজা হত্যার ঘটনা নাকি লুকিয়ে রাখা হয়!
জবাব : এটা সম্পূর্ণ গাঁজাখুরি কথা। পৃথিবীতে যত সীরাত লেখা হয়েছে সব সীরাতেই বনু কুরাইজা হত্যার ঘটনা আছে, কি, কেন, কীভাবে, কোন কারণে এই হত্যা সংগঠিত হয়েছিল সবই সীরাতের কিতাবে লেখা আছে। অতএব এই ঘটনা লুকিয়ে রাখা হয় তা ফালতু কথা। যদি এই ঘটনা লুকিয়ে রাখা আমাদের উদ্দেশ্য হতো তাহলে কিতাবে এসব ঘটনা আমরা লিপিবদ্ধ করতাম না....।
পয়েন্ট -৩
দাবি : বনু কুরাইজাদের বিনা কারণে হত্যা করা হয়েছিল
জবাব : নাস্তিকরা জীবনে সীরাত পড়েছে নাকি সন্দেহ , আর যদি পড়েও থাকে তাহলে এই বিষয়ে তারা সবচেয়ে নিকৃষ্ট মিথ্যাচার করে থাকে। ইসলামে বিনা কারণে হত্যা করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ( মায়েদাহ-৩২) আর বনু কুরাইজা ছিল ইহুদি যাদের সাতে আমাদের চুক্তি ছিল, আর চুক্তি হওয়া কারোর হক নষ্ট করলে বা তার সাতে খারাপ কিছু করলে আল্লাহর রাসূল সেই মুসলিমের বিপক্ষে বাদী হবেন ( আবু দাউদ -৩০৫২) ।
অতএব এতটুকু বলাই যায় যে বনু কুরাইজাদের বিনা কারণে রাসূল সাঃ হত্যা করেন নি কেননা কোরআনে এর নিষেধ আছে, আর রাসূল সাঃ স্বয়ং এই বিষয় থেকে সাবধান করেছেন!
এখন কথা হলো বনু কুরাইজা হত্যা কেন করা হয়েছিল? তাদের কেন হত্যা করা হয়েছিল এটাই আমার আজকের এই লেখার মুখ্য বিষয়। তো চলুন পয়েন্ট শুরু করা যাক।
আমরা জানি যে ইহুদিদের সাথে আমাদের একটা চুক্তি হয়েছিল যেটাকে মদিনা সনদ বলা হয় ( মুহাম্মদ দা ফাইনাল ম্যাসেনজার - ১৩০-১৩১/ আর রাহিকুম মাখতুম - ২৩৬ / সীরাতুর রাসূল -৩৩১-৩৩৭ নং পৃষ্ঠা )
তো এই চুক্তিতে অনেকগুলো ধারা ছিল তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ধারা হলো -
১. চুক্তিবদ্ধ হওয়া দল গুলোর কোনো দল যুদ্ধে লিপ্ত হলে সেই দলের হয়ে যুদ্ধ করবে ( ধারা-২, মুহাম্মদ দা ফাইনাল ম্যাসেনজার)
২. মুসলিমদের সাথে যুক্ত হয়ে যুদ্ধের সময় ইহুদিরাও ব্যয় করবে ( ধারা-২৯, ঐ)
৩.এই সনদে যারা সাক্ষরকারীদের সাথে যারা যুদ্ধরত, তাদের পক্ষে সহায়তা করতে হবে( ধারা - ৪৫, ঐ
৪.যুদ্ধের সময় রাষ্ট্রের হয়ে ইহুদিরাও অর্থ প্রদান করবে ( ধারা -৪৮,ঐ)
৫. কুরাইশূের কোনো আশ্রয় দেওয়া হবে না (ধারা-৫৩,ঐ) .....
( আরও চুক্তি আছে যেগুলো ইহুদিরা লঙ্ঘন করেছিল!)
এরকম আরও অনেক চুক্তি ইহুদিদের সাথে হয়। কিন্তু পরবর্তীতে গিয়ে তারা সেসব চুক্তি রক্ষা করে নি। খন্দকের যুদ্ধের সময় মুসলিমরা বনু কুরাইজার ইহুদিদের কাছে গিয়েছিল চুক্তির কথা স্মরন করিয়ে দিতে, তখন ইহুদিরা ( বনু কুরাইজার লোক) বলে যে " মুহাম্মদকে? তাকে আমরা চিনি না! আর কিসের কি চুক্তি ? " তো এরকম করে তারা চুক্তি ভঙ্গ করে আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। ( মুহাম্মদ দা ফাইনাল ম্যাসেনজার, পৃষ্ঠা নং-২২৬) যুদ্ধের সময়ে আমাদের সাথে একত্রে যুদ্ধ করার কথা থাকলেও তারা সেটা না করে আমাদের শত্রু পক্ষের সাথে গিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, এবং আমাদেরকে যেসব সহায়তা করার কথা ছিল সেগুলোর কোনোটাই করে নি তারা ( ইবনে হিশাম, সিরাতুন নববিয়্যাহ-১/৫০৩) যুদ্ধের পরে এই কুরাইজারা আবার আমাদের চরম শত্রু পক্ষের একজন লিডারকে আশ্রয় দেয় যার নাম " হুয়াই ইবনে আখতার "। তো এরকম করে তারা চুক্তির বিভিন্ন ধারা ভঙ্গ করতে থাকে আর আমাদের সাথেই তারা যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে যায়...... ।
[এইটুকুর তথ্যসূত্র : মুহাম্মদ ফাইনাল ম্যাসেনজার - ২৩১-২৩৪ / সীরাতুর রাসূল,-৪১৬ থেকে ৪২৩ নং পৃষ্ঠা
আর রাহিকুল মাখতুম - ৩৫৭-৩৬১ / সীরাতে হিশাম...]
তো এখন আপনারাই বলুন যে এই বনু কুরাইজা কি নিষ্পাপ ছিল? নাকি তারা শাস্তি পাওয়ার যোগ্য ছিল?
নাস্তিকরা শুধু এতটুকু বলে যে তাদের হত্যা করা হয়েছিল! কিন্তু কেন হত্যা করা হয়েছিল এই কথাটা আর বলে না....।
পয়েন্ট -৪
রাসূল সাঃ কি বনু কুরাইজাদের হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন?
_________________________________________________
এখানে মজার একটা বিষয় আছে। নাস্তিকরা এমন ভাবে বনু কুরাইজা এর হত্যার কাহিনি প্রচার করে যেটাতে দুটো বিষয় মনে হতে পারে -
১. হয় তো বনু কুরাইজারা নির্দোষ ছিল
২. রাসূল সাঃ হিংস্রাবশত বা চরম শত্রুতা বশত বে-ইনসাফ করে বনু কুরাইজাদের হত্যা করে এবং তাদের মেয়ে - কন্যা এবং সম্পদগুলো লুন্ঠন করে নেই বা গণিমত করে!
বনু কুরাইজা যে নির্দোষ ছিল না তা পয়েন্ট -৩ এতে দেখেছি।
এখন আমরা এটা দেখব যে তাদের হত্যার আদেশ কে দিয়েছিল?
বনু কুরাইজা এর দূর্গ যখন অবরোধ করা হয় তখনও রাসূল সাঃকে অশ্শীলভাবে গালি-গালাজ করতে থাকে ওইসব ইহুদিরা। তখবও রাসূল সাঃ তাতে প্রক্রিয়া ব্যক্ত করেন নি! । তাদের যখন অবরোধ করা হয় তখন ইহুদি নেতা " কাব বিন আসাদ" বনু কুরাইজা এর সামনে তিনটা প্রস্তাব রাখেন, কিন্তু তারা তখন কোনো প্রস্তাবে রাজি হয় নি। তারা এক সময় আবু লুবাবাকে তাদের কাছে পাঠাতে বলে তখন নবীজি আবু লুবাবাকে পরামর্শ এর জন্য বনু কুরাইজার কাছে পাঠান.......( এই জায়গায় আবু লুবাবা একটা ভুল করেন যার জন্য তিনি অনুশচিত হয়ে নিজেই রাসূল সাঃ এর কাছে সরাসরি না গিয়ে মিম্বরে গিয়ে নিজেকে বেধে ফেলেন... যাইহোক এই ঘটনা পোস্ট এর সাথে বে- মানান তাই এতটুকু এড়িয়ে যাচ্ছি, এই ঘটনা জানার জন্য পড়ুন- রাহিকুম মাখতুম- ৩৫৮ নং পৃষ্ঠা ..) তো অবরুদ্ধ এর সময় ঘনিয়ে আসে আর আলি রাঃ এক সময় হুলকার প্রদান করেন আর বনু কুরাইজা আত্ম সমপর্ণ করেন! ... । তো সেই সময় যখন ইহুদিরা বুঝতে পারলো তাদের কেও সাহায্য করবে না তখন তারা নবীজি এর কাছে অনুরোধ করে যে " আওস গোত্রের প্রধান " এর নিকট মীমাংসার দায়িত্ব প্রদা করা হয়। সাদ ইবনে মুয়াজের আওস গোত্রের সাথে বনু কুরাইজা এর মিত্রতা ছিল। আর মিত্রতার এরকম সম্পর্ক আরবে রক্তের সম্পর্কের চেয়েও বেশি মজবুত ছিল। সাদ ইবনে মুয়াজ তখন সেই জায়গায় উপস্থিত হোন আর এই শর্ত দেন যে " ইহুদি এবং মুসলিম দু- পক্ষেরই তার রায় মানতে হবে, আর এতে দু- পক্ষই সম্মতি প্রদান করেন। যখন দু- পক্ষই (মুসললিম ও ইহুদি ) তার মানবে বলে ওয়াদা করে তখন সাদ ইবনু মুআজ তাওরাত ( ইহুদিদের কিতাব) অনুসারে এই রায় প্রদান করে যে " প্রত্যেক সক্ষম যোদ্ধাদের হত্যা করা হবে এবং নারীদের ও শিশুদের বন্ধি করা হবে...."( ইবনে আব্দুল বার, আদ দুরার-১৯২/ সিরাতুন নববিয়্যাহ-২/১-৩৬)
পরবর্তীতে সাদ ইবনে মুয়াজ এর রায় মোতাবেক তাদের পুরুষদের হত্যা করা হয়.......। আর এই হত্যা রাসূল সাঃ করতে বলেন নি, বরং ইহুদিরাই যাকে বিচারক করেছিল সেই এই হত্যার রায় প্রদান করেন...... আর এই রায় ছিল যুক্তিসঙ্গত ।
পয়েন্ট -৫
আমরা এই পয়েন্টে দেখব যে এই হত্যা ইহুদিদের শাস্ত্র সম্মত এবং গণিমত নেওয়া বৈধ.....
আমরা প্রথমেই বলেছি যে ইহুদিরাই চুক্তি ভঙ্গ করে নিজেদের শাস্তি যোগ্য করেছিল আর পরবর্তীতে তাদের বিচারকই তাদের হত্যার রায় প্রদান করে। চুক্তি ভঙ্গ করা ওল্ট টেস্টামেনন্ট অনুসারেও একটা ঘৃণিত কাজ। তাওরাতেও চুক্তি ভঙ্গ এর কঠিন শাস্তি এর কথা বলা হয়েছে। যেমন - তাদের প্রতি জ্বর এবং রোগ দেওয়া হবে যেটা তাদের চোখ নষ্ট করবে এবং প্রাণও নিবে। তোমাদের শস্য এর ক্ষতি করা হবে। তোমাদের পরাজয় করা হবে, তোমাদের নগরী ধ্বংস করা হবে। এমন শত্রুদের পাঠানো হবে যারা তোমাদের সনৃতানদের ছিমিয়ে নিবে, তোমাদের প্রাণী হত্যা করবে এবং তোমাদেরও হত্যা করবে...( বিস্তারিত দেখুন, ওল্ট টেস্টামেন্ট, লেবীও পুস্তক -২৬/১৪-২৬ নং পদ..)
তো আমরা দলখতে পাচ্ছি যে চুক্তি ভঙ্গ এর শাস্তি সমূহের ব্যাপারে খোদ তাওরাতই সাক্ষ্য প্রদান করছে... ।
এছাড়াও তাওরাতের প্রথম খন্ডের ২০/১০-১৫ এতে বলা হয়েচে যে
" তোমরা কোনো নগরীতে গেলে তাদের শান্তি প্রস্তাব দাও। যদি তারা রাজি হয় তাহলে ভালো। আর যদি যুদ্ধ করতে আসে তাহলে তাদের অবরুদ্ধ কর এবং পুরুষদের হত্যা করে তাদের নারী, পশু সম্পদ সব তোমরা ভোগ কর..."
লক্ষ্য করুন যে এই কাজগুলোই আমরা বনু কুরাইজা এর সাথে করেছি, যেমনটা তাদের তওরাতে তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে।
অর্থাৎ পুরো বিষয়টাই ইহুদিদের তাওরাতের আলোকে করা হয় যেমনটা সাদ ইবনে মুয়াজ রায় প্রদান করেছিল তাওরাতের আলোকে....। চুক্তি লঙ্গন করা তাওরাত অনুসারেই শাস্তি যোগ্য অপরাধ এবং শাস্তি স্বরুপ হত্যা করা এবং গনিমত নেওয়া তাদের শাস্ত্র অনুসারেই তো বৈধ.... আর আমরা বৈধ কাজটাই করেছি, তাহলে আমাদের দোষটা কি?
তো পরিশেষে আমরা বলব যে সংক্ষিপ্ত আকারে পয়েন্ট বিশ্লেষণ করে আমরা এটা বুঝতে পারলাম যে বনু কুরাইজা হত্যা এবং গণিমত এর বিষয়টা সম্পূর্ণ যুক্তি সঙ্গত এবং বৈধ....... অতএব কারোর এই ব্যাপারে কোনো অভিযোগ থাকার কথা নয়.....
লেখক : মোঃ মেহেদী হাসান ✍️
#প্রিন্স_ফ্রেরাসে