“ধরণীর বুকে পাশাপাশি মোরা, তবু কেউ বুঝি কারো নয়…”
— "তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়"গানের সেই কথা গুলো।
এই একটি লাইনের ভেতরেই আজকের সমাজের পুরো বাস্তবতা ধরা পড়ে। আমরা একই ঘরে, একই বেঞ্চে, পাশাপাশি বসে আছি—তবু মানসিকভাবে আমরা বহু দূরে।
এক সময় মানুষ মানুষের খোঁজ নিত। দেখা হলে কুশল বিনিময় হতো, দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলা হতো। আজ সেখানে দাঁড়িয়ে আমরা কেবল ফেসবুক আইডির নাম বিনিময় করি। একই বেঞ্চে দুজন বসে থাকে, কিন্তু কারো চোখ কারো চোখে পড়ে না—দুজনেই ব্যস্ত ফোনের পর্দায়।
সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে এক অদ্ভুত বৈপরীত্য তৈরি হয়েছে। যারা ভৌগোলিকভাবে দূরে, তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ খুব সহজ হয়ে গেছে। অথচ যারা হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়, তাদের প্রতি অনুভূতি, দায়িত্ববোধ আর মনোযোগ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
এখন আসি সমাজের সবচেয়ে ভয়াবহ বাস্তবতায়—ডিভোর্স।
আজ এমন এক সময় এসেছে, যেখানে ঘণ্টায় যতগুলো বিয়ে হচ্ছে, তার চেয়েও বেশি সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে। কেন?
এর পেছনে বড় একটি কারণ হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়াকে অস্বীকার করা যায় না।
এক সময় ছিল প্রিয় মানুষটি কবে বাড়ি ফিরবে, কবে তার চিঠি আসবে—এই অপেক্ষার মধ্যেই ভালোবাসা বেড়ে উঠত। সেই অপেক্ষা, সেই আকুলতা, সেই ধৈর্য আজ আর নেই। এখন চাইলে মুহূর্তেই কল দেওয়া যায়, মেসেজ করা যায়। দূরত্ব কমেছে ঠিকই, কিন্তু সম্পর্কের গভীরতাও কমে গেছে।
আগে মানুষ কষ্ট পেলে সেই কষ্ট প্রিয়জনের সঙ্গে ভাগ করত। এখন সেই কষ্ট ভুলতে মানুষ রিলস দেখে, স্ক্রল করে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ডুবে থাকে। সময় পেলে কাছের মানুষটিকে “নক” দেওয়ার বদলে ফোনের পর্দায় হারিয়ে যায়। এই নীরব অবহেলাই ধীরে ধীরে সম্পর্কের ভেতর দূরত্ব তৈরি করে।
আগে ফেসবুক ছিল না, পোস্ট ছিল না, কমেন্ট ছিল না।
আজ দেখা যায়—একজন মানুষ নিজের জীবনসঙ্গীর ছবিতে লাইক দেয় না, কিন্তু অন্যের নাচের ভিডিওতে “মাশাআল্লাহ”, “Wow” লিখে কমেন্ট করে। এই ছোট ছোট বিষয়গুলোই সম্পর্কের ভেতরে সন্দেহ, তুলনা আর অভিমান জন্ম দেয়।
যেখানে আগে পাশাপাশি বসে গল্প হতো, এখন সেখানে দুজন পাশাপাশি বসে শুধু ফোন ব্যবহার করে।
যেখানে আগে কথা বিনিময় হতো, এখন সেখানে রিলস ফরোয়ার্ড হয়।
আর শুরু হয় তুলনা—
“ও কত সুন্দর ছবি দেয়, তুমি পারো না।”
“ও কত স্টাইলিশ, তুমি এমন নও।”
একটা পরকীয়ার ভিডিও দেখেই বলা হয়—“তুমিও এর মতো করবা একদিন তাই না?"
এই তুলনাগুলো ভালোবাসা বাড়ায় না, বরং সম্পর্ককে ভেঙে দেয়। মানুষ ভুলে যায়—সোশ্যাল মিডিয়ায় যা দেখা যায়, তার বেশিরভাগই সাজানো, অভিনয় করা, ফিল্টার দেওয়া বাস্তবতা।
আমরা ফোনকে প্রাধান্য দিচ্ছি মানুষের চেয়ে,
স্ক্রলকে গুরুত্ব দিচ্ছি কথোপকথনের চেয়ে,
ভার্চুয়াল প্রশংসাকে গুরুত্ব দিচ্ছি বাস্তব ভালোবাসার চেয়ে—
তারপর অবাক হই, সম্পর্ক কেন টিকে না।
তবে সবাই এক নয়। সবাই পাল্টেও যায়নি।
আজও এমন মানুষ আছে, যারা সোশ্যাল মিডিয়ার ভিড়ের মাঝেও প্রিয়জনের হাতটা শক্ত করে ধরে রাখে।
আজও এমন মানুষ আছে, যারা ফোন নামিয়ে রেখে চোখে চোখ রেখে কথা বলে।
আজও এমন মানুষ আছে, যারা তুলনার বদলে বোঝার চেষ্টা করে, অবহেলার বদলে সময় দেয়, সন্দেহের বদলে বিশ্বাস রাখে।
তারা হয়তো সংখ্যায় কম, কিন্তু তারাই প্রমাণ করে—
সমস্যা যুগের নয়, সমস্যা মানসিকতার।
চাইলেই আজও সম্পর্ক বাঁচানো যায়,
চাইলেই আজও মানুষ মানুষের পাশে থাকতে পারে।
নইলে একদিন সত্যিই এমন সময় আসবে,
যখন ধরণীর বুকে পাশাপাশি থেকেও
আমরা কেউ কারো থাকবো না।