Truth is stranger than fiction -3
ক্লিওপেট্রা:এক নীলনয়নার জীবন ,কিংবদন্তি ও রহস্য
‘চোখে তার যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার!… এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।’ -জীবনানন্দ দাশ
যীশু খ্রিস্টের জন্মের পঞ্চাশ বছর আগে মিশরের জৌলুশময় রাজধানী আলেক্সান্দ্রিয়ায় রাজক্ষমতায় ছিলেন এক তরুণী রানী: ক্লিওপেট্রা।সৌন্দর্যের দেবী হিসেবে যে ক্লিওপেট্রার নাম আমরা সবাই জানি তিনি সপ্তম ক্লিওপেট্রা। তার পুরো নাম Cleopatra VII Thea Philopator.বিচক্ষণ, বুদ্ধিমতী এই নারী গ্রিক ও মিশরীয় ঐতিহ্যের শিক্ষা লাভ করেন এবং রাজনীতির তালিম নেন। প্রথমে রোমান শাসক জুলিয়াস সিজার এবং পরে বিদ্রোহী সমরপতি মার্ক অ্যান্টনির সাথে প্রণয় মারফত তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৩০ সাল পর্যন্ত রোমের হুমকির বিরুদ্ধে নিজের জাতিকে রক্ষার প্রয়াস পেয়েছিলেন। এই সময় রোমান লিজিয়নগুলো নগর প্রাচীরের কাছে পৌঁছে যায়। অ্যান্টনি আত্মহত্যা করেন, ক্লিওপেট্রাকে পাওয়া যায় মৃত। মিশর রোমের করায়ত্ত হয়। ইতিহাস ও কিংবদন্তীর ভেতর পথ করে সর্বকালের সবচেয়ে আলোচিত অন্যতম এই নারীর জীবনের সুলুক সন্ধান করা যাক।
হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড তার ‘ক্লিওপেট্রা’ বইতে ক্লিওপেট্রার সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন এভাবে,
'ক্লিওপেট্রার মুখটা না গোলাকার, না লম্বাটে, বরং দুটোর মাঝামাঝি। ঠোঁট দুটো গোলাপের পাঁপড়ির মতো- টকটকে লালও নয়, আবার কিছু কমও নয়। নাকটা সরু, লম্বা; ঠিক যতটুকু হলে অপূর্ব সুন্দর চেহারার সাথে মানানসই হয়। কপালটা ঢালু, চওড়া। ধনুকের মতো বাঁকানো ভ্রু, লম্বা, বাঁকা পাঁপড়িগুলো মায়াময় চোখগুলোকে পাহারা দিচ্ছে সুদক্ষ প্রহরীর মতো। এত নীল সে দু-চোখের মণি, মনে হয় যেন আকাশের নীল আর সমুদ্রের নীল এক হয়েও হারাতে পারবে না সেই গাঢ়ত্বকে।'
শুধু স্যার হেনরি রাইডারই নয়, শেক্সপিয়ার থেকে শুরু করে অনেক লেখক ক্লিওপেট্রার সৌন্দর্যকে বর্ণনা করেছেন অতুলনীয় রূপে।
সেই প্রাচীন যুগ থেকে আজ পর্যন্ত যত রূপসী নারীর কথা ইতিহাসের পাতায় উঠে এসেছে, তাদের মধ্যে মিশরের সৌন্দর্যের রানী ক্লিওপেট্রার নাম সগৌরবে জ্বলজ্বল করছে। শুধু সৌন্দর্য নয়, বুদ্ধিমত্তায়ও তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী।তাহলে কে এই ক্লিওপেট্রা, যার জন্য রচিত হয়েছে এত শত কাহিনী? চলুন জেনে নেওয়া যাক তার জীবন সম্পর্কে।
সপ্তম ক্লিওপেট্রা বা ক্লিওপেট্রা ফিলোপাটোর প্রাচীন মিশরের সর্বশেষ ফেরাউন ছিলেন এবং তার আগেও মিশরে বেশ কয়েকজন ক্লিওপেট্রার নাম পাওয়া যায়। তবে তাদের কেউই ক্লিওপেট্রার মতো এতটা খ্যাতি অর্জন করতে পারেনি।ক্লিওপেট্রার জন্ম হয় খ্রিস্টপূর্ব ৬৯ সালে মিশরের টলেমি রাজবংশে, যা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মৃত্যুর পর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। টলেমি রাজবংশের রীতি অনুসারে, রাজা বা রানির অধিকার এককভাবে না দিয়ে ভাগাভাগি করা হতো। তার পিতা দ্বাদশ টলেমি মৃত্যুর আগে মিশরের ক্ষমতা ক্লিওপেট্রা এবং তার ভাই ত্রয়োদশ টলেমির মধ্যে ভাগ করে দেন।
প্রাচীন মিশরে নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিবাহের রীতি ছিল রাজপরিবারের রক্ত বিশুদ্ধ রাখার উদ্দেশ্যে। ক্লিওপেট্রা এবং তার ভাই ত্রয়োদশ টলেমি একত্রে শাসন শুরু করেন, তবে তাদের মধ্যে শাসন নিয়ে বিরোধ শুরু হলে ক্লিওপেট্রাকে রাজপ্রাসাদ থেকে বিতাড়িত করা হয়। পরবর্তীতে, রোমের শাসক জুলিয়াস সিজারের সহায়তায় ক্লিওপেট্রা আবার মিশরের শাসনকর্ত্রী হন এবং তার ভাইকে পরাজিত করেন।
ক্লিওপেট্রা জুলিয়াস সিজারের সাথে প্রথম সাক্ষাত করেন ছিল খুবই মজার একটি ঘটনা। তিনি একটি গালিচায় নিজেকে মুড়িয়ে জুলিয়াস সিজারের সামনে হাজির হন। এই ঘটনাটি তাকে সিজারের প্রতি গভীর আকর্ষণ তৈরি করতে সাহায্য করে এবং পরে দুজনের মধ্যে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে।রানী ক্লিওপেট্রার সৌন্দর্য এবং বুদ্ধিমত্তায় আকৃষ্ট হয়ে সম্রাট জুলিয়াস সিজার তার প্রেমে পড়েন। সেই সময়ে ক্লিওপেট্রা তার প্রেমিক জুলিয়াস সিজারের এক ছেলের জন্ম দেন, যদিও সিজার প্রকাশ্যে কখনোই তাকে ছেলে হিসেবে স্বীকৃতি দেননি। খ্রিষ্টপূর্ব ৫১ অব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০ অব্দ পর্যন্ত মিশর শাসন করার মাধ্যমে নিজেকে এক যোগ্য শাসক হিসেবে প্রমাণ করেন তিনি। অর্থনৈতিকভাবে মিশরকে বেশ এগিয়ে নেন ক্লিওপেট্রা। ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক, দু’দিকেই বহির্বিশ্বের সাথে তার সুসম্পর্ক বজায় ছিল। রপ্তানি ব্যবস্থারও দারুণ উন্নতি সাধন হয় সেসময়।
জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুর পর ক্লিওপেট্রা মার্ক এন্টোনির সাথে মিত্রতা করেন, যার ফলে তারা দু'জনই রোমান সেনাপতি অক্টাভিয়ানের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। এটি ঐতিহাসিকভাবে "অক্টাভিয়ান বনাম এন্টনি ও ক্লিওপেট্রা" যুদ্ধের দিকে পরিচালিত করে, যা শেষ পর্যন্ত ক্লিওপেট্রা ও এন্টোনির পরাজয় এবং তাদের আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে শেষ হয়।
ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর ঘটনাটি কিংবদন্তি হয়ে উঠেছে। বলা হয়, অক্টাভিয়ানের সেনাদের দ্বারা বন্দি হওয়ার পর খ্রিস্টপূর্ব ৩০ সাল বন্দী ক্লিওপেট্রা বিষাক্ত মিশরীয় গোখরা সাপের (অ্যাম্প নামক এই সাপ লম্বায় কয়েক ইঞ্চি হলেও খুবই বিষাক্ত। কথিত আছে- এই সাপ তার কাছে ডুমুরের ঝুড়িতে লুকিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়) কামড়ে আত্মহত্যা করেন।তবে অনেক ঐতিহাসিক এটিকে অস্বীকার করেন। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিয়ে এখনও বিতর্ক রয়েছে। অনেকের মতে, ক্লিওপেট্রা আত্মহত্যা করেননি, বরং খুন হয়েছিলেন।
'তাঁর মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত করে বলতে পারেনি
কেউ। স্রেফ তাঁর বাহুতে ক্ষুদে একটা ক্ষতচিহ্ন দেখতে পেয়েছে ওরা। কারও কারও মতে একটা সাপ জোগাড় করেছিলেন তিনি...'
-দিয়ো ক্যাসিয়াস, রোমান হিস্ট্রি, ২য়-৩য় শতক
ইতিহাসবিদদের মতামত ভিন্ন হলেও একসময়ের ক্ষমতাধর রানীর যে করুণ পরিণতি হয়েছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ক্লিওপেট্রার সমাধি নিয়ে বহু শতাব্দী ধরে রহস্য রয়ে গেছে। ক্লিওপেট্রা এবং তার প্রেমিক রোমান সেনাপতি মার্ক এন্টোনি আত্মহত্যার পর, তাদের সমাধি কোথায় স্থাপন করা হয়েছিল তা আজও অজানা। ক্লিওপেট্রার সমাধি সম্পর্কে কিছু প্রাচীন রোমান ঐতিহাসিক, বিশেষ করে প্লুটার্ক, লিখেছেন যে ক্লিওপেট্রা এবং মার্ক এন্টোনিকে একসঙ্গে দাফন করা হয়েছিল, এবং তাদের সমাধি ছিল অত্যন্ত সুন্দর এবং রাজকীয়।
তবে তাদের সমাধির সঠিক অবস্থান এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক মনে করেন যে ক্লিওপেট্রার সমাধি মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরের কাছাকাছি কোথাও রয়েছে, যেহেতু ক্লিওপেট্রার অধিকাংশ জীবন সেখানে কেটেছে এবং এটি ছিল তার শাসনের প্রধান কেন্দ্র। কিছু গবেষক বিশ্বাস করেন যে আলেকজান্দ্রিয়ার সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে, যা সময়ের সাথে সাথে ভূমধ্যসাগরের তলদেশে ডুবে গেছে, সেখানে হয়তো ক্লিওপেট্রার সমাধি লুকিয়ে থাকতে পারে।
ক্লিওপেট্রার সমাধি সন্ধানের জন্য অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযান পরিচালিত হয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত এটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। এটি একটি ঐতিহাসিক রহস্য হিসেবে এখনও বিজ্ঞানীদের আকৃষ্ট করে চলেছে, এবং যদি এটি কখনও আবিষ্কৃত হয়, তবে তা হবে প্রত্নতত্ত্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার।
ক্লিওপেট্রার জীবন ছিল ইতিহাস, প্রেম এবং রাজনীতির একটি অমর কাহিনী, যা এখনও বিভিন্ন সাহিত্য, নাটক এবং চলচ্চিত্রের মাধ্যমে স্মরণ করা হয়।ক্লিওপেট্রার জীবন এতটাই রহস্যময় এবং উত্তেজনাপূর্ণ যে তিনি ইতিহাসের পৃষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছেন।জীবনানন্দের লেখায় ফিরি- ‘ এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর’।
-
মাহমুদুল হাসান মৃদুল,
টিম ই-নলেজ।
#Truth_is_stranger_than_fiction