Truth is stranger than fiction -2
অ্যাডলফ হিটলার :ইতিহাসের নিমর্ম খলনায়কের জীবনচরিত
১৯০৬ সাল।অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা শহরে এক চিত্রশিল্পী আরেক ইহুদি কন্যার প্রেমে পড়ে,তারই ছবি আঁকতে গিয়ে!এরপর থেকে ছেলেটি অর্থাৎ চিত্রশিল্পীটি তার প্রিয় কুকুরটির মাধ্যমে মেয়েটির কাছে চিঠি পাঠাতো। কিন্ত ধনাঢ্য মেয়ের পরিবার এই গরীব ছেলেটিকে মেনে নিতে রাজি হয়নি।একদিন তারা ছেলেটির প্রিয় কুকুর টিকে মেরে ফেলে।ছেলেটির জীবন বদলে যায় এই ঘটনার মাধ্যমে।সে যোগ দেয় সেনাবাহিনীতে।১৯১৮ সালে এক ব্রিটিশ সেনা তাকে পিটিয়ে জখম করে,শুধু তাই নয় তাকে হত্যার আদেশও ছিল।কিন্ত ব্রিটিশ সেনা দয়া করে তাকে ছেড়ে দেয়।তবে সেই ছেলেটি পরবর্তীকালে পরিণত হয় এক ভয়ানক শাসকে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আনুমানিক ষাট লক্ষ ইহুদি মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল তারই নিদের্শে!এতক্ষণে অনেকে হয়তোবা ধারণা করে ফেলেছেন কার কথা বলা হচ্ছে।হ্যাঁ,ঠিক ধরেছেন আমরা এতক্ষণ শুনছিলাম ইতিহাসের অন্যতম খলনায়ক 'হিটলার' সম্পর্কে।
তার জীবন বৃত্তান্ত এবং তার জীবনের লোমহর্ষক অধ্যায় গুলি সম্পর্কে জানবো আমরা আজকে।
হিটলার, পুরো নাম অ্যাডলফ হিটলার। অস্ট্রীয় বংশোদ্ভূত এই জার্মান রাজনীতিবিদ জার্মানির নাৎসি বা নাজি দলের নেতা ছিলেন। ১৯৩৩ সালে জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। ১৯৩৪ সালে নাৎসি জার্মানির ফুয়েরার (নেতা) হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দেন। একনায়ক হিসেবে ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর জন্য তাঁকে দায়ী করা হয়।তাঁর নেতৃত্বে জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে এবং ১৯৩৯ সালে তাঁর নেতৃত্বেই জার্মানরা পোল্যান্ড দখল করে নেয়। তাতে ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এভাবেই তার কারণে শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।এরপর নাৎসি পার্টির আদর্শ অনুসারে ব্যাপক অত্যাচার ও গণহত্যা সংগঠিত হয়, যা মানব ইতিহাসের অন্যতম অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত।
অ্যাডলফ হিটলারের জন্ম হয়েছিল ২০ এপ্রিল ১৮৮৯ সালে সন্ধে সাড়ে ছটার সময়। অস্ট্রিয়ার ব্রুনাউ আম ইন শহরে, যা ছিল জার্মান বাভারিয়ার সীমান্তের কাছেই। তার বাবা ছিলেন আলোইস সিকলগ্রুবার হিটলার এবং মা ক্লারা পোলজ।তার বাবা ছিলেন একজন অস্ট্রিয়ান সরকারি কর্মচারী। হিটলারের যখন ছয় বছর বয়স তখন বাবা অবসর নেন।তার বাবার অবসরের পর অস্ট্রিয়ার লিঞ্জের এলাকায় একটি ছোটো খামারবাড়ি চলে আসেন। সেখানে হিটলার পরিবারের সাথে তার শৈশব কাটান এবং সেখানেই বেড়ে উঠেন।হিটলার এক অস্থির শৈশব পার করেছেন। তাঁর বাবা ছিলেন কঠোর ও প্রায়শই হিটলারকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করতেন। এই কঠোর শৈশব তাঁর মানসিকতায় গভীর প্রভাব ফেলেছিল।যার ফলাফল পরবর্তীতে ভয়ঙ্কর হয়!
যাইহোক,ছোটবেলায় তিনি চিত্রশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন এবং সে উদ্দেশ্যই ১৯০৫ সালে স্কুল ছেড়ে দেওয়ার পর, তিনি ভিয়েনায় চলে আসেন এবং সেখানে শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি ভিয়েনার একাডেমি অফ ফাইন আর্টসে দু'বার ভর্তির জন্য আবেদন করেছিলেন, কিন্তু তাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল।
এভাবে সেখানে তিনি ভর্তি হতে ব্যর্থ হন।অগত্যা সে অর্থে শিক্ষাহীন বেকার হিটলার ভিয়েনার রাস্তায় রাস্তায় অর্থ রোজগারের তাড়নায় পোস্টকার্ড পেইন্টিং করতে শুরু করেন। বসবাস করতে থাকেন সবচেয়ে কম খরচে থাকা যায় এমন সব নিম্নমানের আস্তানায়।এভাবেই তাঁর কৈশোরকাল এবং প্রাথমিক জীবনে দরিদ্রতা ও অস্থিরতার মধ্যে কাটে।
ভিয়েনা থাকার সময়টিতে তিনি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হন এবং ইহুদি বিদ্বেষী ও জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন। ১৯১৩ সালে, হিটলার জার্মানির মিউনিখ শহরে চলে যান এবং সেখানে ১৯১৪ সালের ৪ আগস্ট প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর প্রধান রাজনৈতিক দল ছিলো লেবার পার্টি।১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি সেই পার্টির সদস্য হলেন।অল্পদিনেই পাকাপাকিভাবে পার্টিতে নিজের স্থান করে নিতে সক্ষম হয় হিটলার। এক বছরের মধ্যেই তিনি হন পার্টিপ্রধান। দলের নতুন নাম রাখা হয় ন্যাশনাল ওয়ার্কার্স পার্টি।
পরবর্তীকালে এই দলকেই বলা হতো নাৎসি পার্টি
তিনি খুব দ্রুত নাৎসি পার্টির নেতা হয়ে উঠেন এবং তাঁর বক্তৃতাগুলি ব্যাপক সমর্থন লাভ করে। ১৯২৩ সালে হিটলার মিউনিখের বিয়ার হল পুটসচের সময় ব্যর্থভাবে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন, যার ফলে তিনি কারাবন্দী হন। কারাগারে বসে তিনি তাঁর আত্মজীবনী "মাইন ক্যাম্পফ" (আমার সংগ্রাম) লিখেন, যেখানে তাঁর নাৎসি আদর্শ ও ইহুদি বিদ্বেষের ব্যাখ্যা রয়েছে।
জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মোহনীয় বক্তৃতার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ, ইহুদি বিদ্বেষ ও সমাজতন্ত্র বিরোধিতা ছড়াতে থাকেন। এভাবেই এক সময় জনপ্রিয় নেতায় পরিণত হন।১৯৩৩ সালে হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হন এবং ধীরে ধীরে তিনি সকল রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরিয়ে দিয়ে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানি ইউরোপের বিভিন্ন দেশ দখল করতে থাকে, যার ফলে ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।তখন থেকেই তাঁর ইহুদি বিরোধী নীতি এবং "হলোকাস্ট" (ইহুদি নিধন) এর ফলে প্রায় ৬০ লাখ ইহুদি ও অন্যান্য সংখ্যালঘু মানুষ প্রাণ হারান।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে কেন হিটলার ইহুদিদের দেখতে পারতেন না? কেনই বা নিজেই একজন ইহুদি হয়ে লক্ষ লক্ষ ইহুদি হত্যা করেছিলেন?
হিটলারের ইহুদিবিদ্বেষ এবং তার ইহুদিদের ওপর নির্বিচারে অত্যাচার করার পেছনে বেশ কয়েকটি জটিল কারণ ছিল, যদিও তিনি নিজে ইহুদি ছিলেন এমন কোনো প্রমাণ নেই। আসলে, এই ধারণাটি সম্পূর্ণভাবে ভিত্তিহীন এবং ইতিহাসবিদদের দ্বারা খণ্ডিত হয়েছে।
হিটলারের ইহুদিদের প্রতি ঘৃণার মূল কারণ ছিল একধরনের জাতিগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিশ্বাস, যা ১৯শ শতক এবং ২০শ শতকের প্রথম দিকে ইউরোপে প্রচলিত ছিল। তিনি মনে করতেন যে ইহুদিরা জার্মানির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর জন্য দায়ী। এর সাথে তিনি "আর্য জাতি"কে (Germanic people) শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন এবং ইহুদিদের নিচু বা দূষিত জাতি হিসেবে বিবেচনা করতেন।তিনি বিশ্বাস করতেন ইহুদিরা ছিল মানবজাতির জন্য হুমকি। তার রাজনৈতিক দল নাৎসি পার্টির মতাদর্শও ছিল ইহুদিদের নির্মূল করে একটি বিশুদ্ধ আর্য সমাজ গঠন করা।
তাছাড়া, হিটলার ও তার সহযোগীরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির পরাজয়ের জন্য ইহুদিদের দায়ী করেছিল। তারা দাবি করেছিল যে ইহুদিরা গোপনে জার্মানিকে দুর্বল করেছে এবং যুদ্ধের সময় তাদের স্বার্থের জন্য কাজ করেছে।
হিটলার তার মতাদর্শ ও ইহুদিদের বিরুদ্ধে ঘৃণাকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় আসেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় "হলোকাস্ট" নামে পরিচিত গণহত্যায় লক্ষ লক্ষ ইহুদি, রোমা, প্রতিবন্ধী, সমকামীসহ আরও অনেক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে নির্মমভাবে হত্যা করেন।
হিটলার তার শাসনামলে শুধুমাত্র ইহুদি জনগোষ্ঠীকেই নয়, যেসব লোক তাঁর বিরোধিতা করত বা তাঁর মতাদর্শের সাথে দ্বিমত পোষণ করত, তাদেরকেও নির্মমভাবে হত্যা করত। ১৯৩৪ সালে, "নাইট অফ দ্য লং নাইভস" নামে পরিচিত একটি ঘটনা ঘটে, যেখানে হিটলার তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ব্যাপকভাবে হত্যা করায়।
কথিত আছে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সময়ে হিটলার অন্তত ১ কোটি ১০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছেন। যাদের মধ্যে হিটলারের নাৎসি জার্মান বাহিনী ও দালালদের হাতে নিহত হয় ৬০ লাখ ইহুদি বাকি ৫০ লাখ অ-ইহুদিকে হত্যা করা হয় গণহত্যার সময়ে। এ হত্যাকাণ্ড চলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত।
নাৎসিদের এই গণহত্যার শিকার যেসব অ-ইহুদি তাদের মধ্যে আছে সাধারণ যাযাবর, রোমানি যাযাবর, পোল্যান্ডবাসী, কমিউনিস্ট, সমকামী, সোভিয়েত যুদ্ধবন্দী এবং মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী কিছু মানুষ।
হিটলার বিশ্বযুদ্ধের সময় বিভিন্ন ধরনের ভয়াবহ গুপ্ত অস্ত্রের পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি ভি-২ রকেট, যা ছিল বিশ্বের প্রথম দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, এর উন্নয়ন করেছিলেন।
যাইহোক,দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে হিটলার তার আন্ডারগ্রাউন্ড বাঙ্কারে লুকিয়ে ছিলেন। এই বাঙ্কারে তার শেষ দিনগুলি অতিবাহিত হয়েছিল। বলা হয় যে, এই সময়ে হিটলার মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন এবং বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন।
হিটলার এসময় প্রচন্ড রকমের মাদকাসক্ত ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত ডাক্তার তাকে বিভিন্ন ধরনের মাদক ও অ্যানফিটামিন দিতেন, যার কারণে তাঁর আচরণ ক্রমশ অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল।হিটলারের ব্যক্তিগত ডাক্তার থিওডর মোরেল মোরেল নিয়মিত হিটলারকে স্টেরয়েড এবং এমফিটামিনের মতো ড্রাগ দিতেন, যা তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল।
তারপর যুদ্ধের শেষের দিকে মিত্রবাহিনী হিটলারের বাহিনীকে পরাজিত করে।১৯৪৫ সালে এপ্রিলে রাশিয়ার রেড আর্মি বার্লিন দখল করার পর শেষরক্ষা হচ্ছে না বুঝতে পেরে আত্মহত্যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন হিটলার। সেটা বাস্তবায়ন করেন ৩০ এপ্রিল দুপুরের দিকে। বাংকারে নিজের কপালের ডান পাশে গুলি করেন তিনি। সঙ্গী হন স্ত্রী ইভা ব্রাউন। তিনি বিষ পান করে মৃত্যুকে বেছে নেন। তার আগে হিটলার–ইভা তাঁদের প্রিয় কুকুরকেও বিষ খাইয়ে হত্যা করেন।এভাবেই পরি সমাপ্তী ঘটে ইতিহাসের অন্যতম খলনায়কের জীবনের।
-
মাহমুদুল হাসান মৃদুল,
লেখক,টিম ই-নলেজ।
#Truth_is_stranger_than_fiction