অসম্ভব সত্যের খোজে -১"
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট:জীবন,কিংবদন্তী ও রহস্য
গ্রিসের মেসিডোনিয়ার তৃতীয় আলেকজান্ডার ইতিহাসে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট নামে পরিচিত ,বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম বিখ্যাত সেনাপতি ছিলেন তিনি। মাত্র ২০ বছর বয়সে সম্রাট হয়েছিলেন তিনি এবং পরবর্তী ১৩ বছরে তিনি এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, যা তার মৃত্যুর সময়ে গ্রিস থেকে শুরু করে মিশর এবং ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।মাত্র ৩০ বছর বয়সের মধ্যেই তিনি ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সেই আমলের মানচিত্রে চোখ বুলালেই অনুমান করা যাবে কত বড় বীর ছিলেন আলেকজান্ডার।
রাজ্য জয়, সাম্রাজ্য দখল আর বীরত্বের যে ইতিহাস তাতে আলেকজান্ডারের নাম আসে সবার প্রথমে। এই সেনানায়কের বীরত্বগাথা, মেধা, সাহস, সৌকর্য, বুদ্ধি, পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন, মহত্ত্ব, দয়া এবং একই সঙ্গে নৃশংসতা ইতিহাসের এক অনন্যসাধারণ অধ্যায়।তার জীবনের সেই লোমহর্ষক এবং রহস্যময় অধ্যায় গুলি সম্পর্কে জানবো আমরা আজকে।
আলেকজান্ডার ৩৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জুলাই মাসে ম্যাসিডনের রাজধানী পেলা শহরে জন্মগ্রহণ করেন।তিনি ছিলেন মেসিডোনিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ ও তার চতুর্থ স্ত্রী অলিম্পাসের সন্তান।তার বাবা ফিলিপ প্রাচীন গ্রিসের ম্যাসিডনের রাজা ছিলেন।যা বর্তমানে মেসিডোনিয়া নামে পরিচিত।
অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন আলেকজান্ডার। বলিষ্ট চেহারায় রূপ আর শক্তির মিশেলে তিনি অন্য সকল রাজার থেকে ছিলেন স্বতন্ত্র।তার বাবা ফিলিপ আলেকজান্ডারকে বলেছিলেন, “ম্যাসিডন বড়ই ছোট তোমার পক্ষে, একদিন সারা পৃথিবী জয় করবে তুমি।” তার বাবার কথাই সত্যি হয়েছিল। একের পর এক দেশ জয় করতে করতে পারস্য, মিশর, এশিয়া মাইনর হয়ে ভারতের পশ্চিমেও চলে এসেছিল আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনী।
আলেকজান্ডার মেসিডোনিয়ার পেলা শহরে বেড়ে উঠেছিলেন, যা ছিল মেসিডোনিয়ার রাজধানী। পেলা তখনকার সময়ের একটি সমৃদ্ধ ও সাংস্কৃতিকভাবে উন্নত শহর হিসেবে পরিচিত ছিল। এখানেই তার শৈশব এবং প্রাথমিক শিক্ষার সময় কেটেছে।আলেকজান্ডারের গুরু ছিলেন গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল, যিনি তাকে বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র,রাজনীতি এবং সাহিত্য সম্পর্কে শিক্ষা দেন।মূলত এই সুশিক্ষার কারণেই আলেকজান্ডার প্রচণ্ড শারীরিক দৃঢ়তা ও মেধার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।পেলা থেকেই আলেকজান্ডারের সামরিক এবং রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়, যা পরবর্তীতে তার বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ভিত্তি গড়ে তোলে।
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সামরিক অভিযানের শুরু পিতা ফিলিপের মৃত্যুর পর। তিনি প্রথমে গ্রিসের সিটি-স্টেটগুলোকে একত্রিত করেন এবং পরে পারস্য সাম্রাজ্য জয় করার দিকে মনোযোগ দেন।তিনি ৩৩৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্য সম্রাট ডেরিয়াস III-কে পরাজিত করেন।৩৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ডেরিয়াস III-কে পুনরায় পরাজিত করে পারস্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটান আলেকজান্ডার।
৩৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, পারস্য সাম্রাজ্য পরাজয়ের পর, আলেকজান্ডার মিসরে প্রবেশ করেন এবং সেখানে পারসিক শাসন অবসানের মাধ্যমে মিসর দখল করেন।আলেকজান্ডার যখন মিসরে পৌঁছান, মিসরের জনগণ তাকে মুক্তিদাতা হিসেবে বরণ করে। পারস্য শাসনের অধীনে থাকা মিসরের জনগণ আলেকজান্ডারকে সমর্থন করে এবং তার আগমনে কোনো বড় প্রতিরোধ হয়নি। পারস্যের শাসকরা তাকে চ্যালেঞ্জ করতে না পারায় আলেকজান্ডার সহজেই মিসর দখল করেন।খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩২ সালে তিনি আলেকজান্দ্রিয়া শহর প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাচীন মিসরের রাজধানী ছিল এ শহরটি।আলেকজান্দ্রিয়া শহরটি পরবর্তীতে বাণিজ্য, শিক্ষা এবং সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি বিশাল রাজপ্রাসাদ, লাইব্রেরি এবং শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি প্রাচীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং সমৃদ্ধ লাইব্রেরি হিসেবে পরিচিত ছিল, যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে জ্ঞান ও তথ্য সংরক্ষিত থাকত।
এবার কিছু মজার তথ্য জানাই। বলা হয়, আলেকজান্ডার তার বালিশের নিচে সবসময় হোমারের "ইলিয়াড" বই এবং একটি তলোয়ার রাখতেন। হোমারের বীরত্বগাঁথা তাকে অনুপ্রাণিত করত এবং তলোয়ার তাকে তার সামরিক দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিত।
তুরস্কের গর্ডিয়ামে একটি বিখ্যাত কিংবদন্তি ছিল যে, কেউ যদি একটি অত্যন্ত জটিল গিঁট খোলতে পারে, সে হবে এশিয়ার শাসক। আলেকজান্ডার প্রচলিত কৌশল ছেড়ে, তরবারি দিয়ে গিঁটটি কেটে ফেলে এবং দাবি করে যে তিনি সমস্যার সমাধান করেছেন। পরে তিনি সত্যিই এশিয়া জয় করেন।
যাইহোক,পারস্য সাম্রাজ্য জয় করার পর এবং আলেকজান্দ্রিয়া শহর প্রতিষ্ঠার পর , আলেকজান্ডারের লক্ষ্য ছিল আরও পূর্ব দিকে অগ্রসর হওয়া এবং পুরো পৃথিবী জয় করা।এরই ধারাবাহিকতায় আলেকজান্ডার একের পর এক রাজ্য জয় করে যাচ্ছিলেন।পরে তিনি জানতে পারেন যে বর্তমান উত্তর-পশ্চিম ভারতের (তৎকালীন পাঞ্জাব অঞ্চল) ওপারেও অনেক সমৃদ্ধ সাম্রাজ্য রয়েছে। সেই আকাঙ্ক্ষায় তিনি ভারত অভিযান শুরু করেন।
এ সময় তিনি ভারত আক্রমণ করেন।৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার ভারতের পাঞ্জাব অঞ্চলে রাজা পুরুর বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করেন।রাজা পুরুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে, আলেকজান্ডার তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন লড়াইগুলোর একটি করেন, যেখানে পুরুর বিশাল হাতি বাহিনীর মুখোমুখি হতে হয়। আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনী প্রথমবারের মতো যুদ্ধের ময়দানে এতগুলো হাতির মুখোমুখি হয়।তবে অবশেষে তার বাহিনীর জয় হয়।এভাবে তিনি মিসর থেকে উত্তর-পশ্চিম ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত সাম্রাজ্যের সম্রাটে পরিণত হন। তবে ভারতে আলেকজান্ডারের অভিযান সফল হলেও তার সৈন্যরা দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তারা গ্রীসে ফিরে যেতে চেয়েছিল এবং আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্যের আরও পূর্বদিকে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। এই বিদ্রোহের ফলে আলেকজান্ডারকে তার আরও পূর্বমুখী অভিযান বন্ধ করতে হয় এবং তিনি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
ভারত থেকে ফিরে যাওয়ার পথে আলেকজান্ডার মাকরান মরুভূমি (বর্তমান পাকিস্তানের বালুচিস্তান অঞ্চল) দিয়ে যাত্রা করেন, যেখানে তার সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য দুর্ভিক্ষ ও তৃষ্ণার কারণে মারা যায়। ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলনে পৌঁছানোর পর আলেকজান্ডার মারা যান।
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মৃত্যু এবং তার সমাধী ইতিহাসের সবচেয়ে রহস্যময় ও বিতর্কিত বিষয়গুলোর একটি হয়ে দাঁয়েছে।আলেকজান্ডার ৩২৩ খ্রিস্টপূর্ব জুন মাসের ১০ মতান্তরে ১১ তারিখে ব্যাবিলনে দ্বিতীয় নেবুচাদনেজারের প্রাসাদে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল মাত্র ৩২ বছর। তবে তার মৃত্যুর কারণ নিয়ে অনেক তত্ত্ব ও বিতর্ক রয়েছে। অনেকে মনে করেন, আলেকজান্ডার ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, বা অন্য কোনো সংক্রামক রোগে মারা যান। তার দীর্ঘ এবং কঠিন সামরিক অভিযানের ফলে তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন, যা তার স্বাস্থ্যের অবনতির কারণ হতে পারে।আবার কিছু তত্ত্ব মতে, আলেকজান্ডারকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল। যেহেতু তার মৃত্যুর পর ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়, তাই ধারণা করা হয় শত্রু বা তার নিজের লোকজনই তাকে হত্যা করতে পারে।
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর আগে তিনি ব্যাবিলনে একটি ভোজসভায় অংশ নেন, যেখানে তার স্বাস্থ্য হঠাৎ করে খারাপ হতে শুরু করে। তিনি জ্বরে ভুগতে শুরু করেন এবং শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। তার অসুস্থতা ক্রমশ বেড়ে যায় এবং কয়েক দিনের মধ্যে তিনি মারা যান।
আলেকজান্ডারের সমাধীর অবস্থান আজও রহস্যময়। ঐতিহাসিক নথি অনুযায়ী, তার দেহ প্রথমে মিশরের মেমফিসে সমাহিত করা হয় এবং পরে আলেকজান্দ্রিয়া শহরে স্থানান্তরিত করা হয়। কিছু প্রাচীন সূত্রে বলা হয়েছে, আলেকজান্ডারের সমাধী একটি সুবিশাল মাজারের মধ্যে রাখা হয়েছিল, যেখানে মিশরের একটি বংশ তার শাসনকালের সময় এটি রক্ষণাবেক্ষণ করত। তবে আলেকজান্দ্রিয়া শহরের মাটির নিচে তার সমাধী কোথায় ছিল তা স্পষ্টভাবে জানা যায় না। মধ্যযুগের বিভিন্ন সময়ে সমাধীর অবস্থান হারিয়ে যায় এবং আজও এটি একটি বড় রহস্য।
বিজ্ঞানীরা এখনো হন্য হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন রাজা আলেজান্ডারের সমাধি।অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক আলেকজান্ডারের সমাধী খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয় যে এটি আলেকজান্দ্রিয়ার কোনো স্থানে হারিয়ে গেছে বা ধ্বংস হয়ে গেছে।ফলে আজও এ রহস্যর ইতি টানা সম্ভব হয়নি।
যাইহোক,আলেকজান্ডারের জীবন সাহস, দক্ষতা, এবং অপ্রতিরোধ্য আত্মবিশ্বাসে পূর্ণ ছিল, যা তাকে ইতিহাসের অন্যতম বিখ্যাত এবং রহস্যময় ব্যক্তিত্ব হিসেবে তৈরি করেছে।
-