গত ২০২২-২৩ সালের দিকে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডার (UCF) একদল গবেষক একটি অভাবনীয় ন্যানো পার্টিকেল প্রযুক্তি, অর্থাৎ প্লাজমোনিক রং, আবিষ্কার করেন। বর্তমানে এই যুগান্তকারী উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইউসিএফ-এর ন্যানো সায়েন্স টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক দেবাশিস চন্দ।
তিনি এবং তার গবেষক দল প্রকৃতির প্রজাপতির ডানা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে এই রং নিয়ে গবেষণা করছেন। প্রজাপতির ডানায় থাকা সূক্ষ্ম ন্যানো গঠন আলোর প্রতিফলনের মাধ্যমে যেভাবে বৈচিত্র্যময় ও উজ্জ্বল রং তৈরি করে, ঠিক সেই 'স্ট্রাকচারাল কালার' ধারণাকেই কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা এবার ল্যাবেই তৈরি করছেন ন্যানো পার্টিকেল বা প্লাজমোনিক রং।
এই প্লাজমোনিক রং তৈরির প্রক্রিয়া বর্তমানে গবেষণা ও উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত গবেষণাগারে খুবই অল্প পরিমাণে এই প্রযুক্তির রং তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। গবেষকদের দাবি অনুযায়ী, এই রং হবে অত্যন্ত হালকা, পরিবেশবান্ধব এবং তাপ প্রতিরোধে সক্ষম। ফলে ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তির রং রঙের জগতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
এই প্লাজমোনিক রং তৈরি করা হয় ধাতব ন্যানো পার্টিকেলের ‘লোকালাইজড সারফেস প্লাজমোন রেজোন্যান্স’ (LSPR) নামক একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এখানে ধাতব কণাগুলোর পৃষ্ঠে নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো প্রতিফলিত ও শোষিত হয়ে কাঙ্ক্ষিত রং তৈরি করে। এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা অ্যালুমিনিয়াম ন্যানো পার্টিকেল ব্যবহার করছেন, যা কোনো ধরনের রঞ্জক ছাড়াই কেবল আলোর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় নির্দিষ্ট রং প্রদর্শন করতে পারে।
বিজ্ঞানীরা দাবি কএন যে, পরিবেশবান্ধব এই রং এ কোন বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান নেই এবং এটি গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে সহায়ক হবে। এটি প্রচলিত রঞ্জক রঙের তুলনায় অনেক বেশি দীর্ঘস্থায়ী, সূর্যের তাপ ও অতিবেগুনি রশ্মি থেকে রক্ষা করতে সক্ষম। বিজ্ঞানীরা আরও জানান, মাত্র তিন পাউন্ড এই হালকা ওজনের রং দিয়েই একটি সম্পূর্ণ বোয়িং ৭৪৭ বিমানের রংকরণ সম্ভব, যা জ্বালানি সাশ্রয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
এই প্রযুক্তির বহুমুখী ব্যবহার সম্ভাবনার দিক থেকে বিস্তৃত। এটি উচ্চ রেজোল্যুশনের ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে ও সেন্সর প্রযুক্তিতে প্রয়োগ করা যেতে পারে। তাছাড়া এয়ারক্রাফট ও মহাকাশযানের ওজন কমানোর পাশাপাশি গাড়ি, যন্ত্রপাতি এবং বিভিন্ন ইলেকট্রনিক গ্যাজেটে প্রিমিয়াম লুক ও স্ক্র্যাচপ্রুফ এবং টেকসই করতে এই রং ব্যবহৃত হতে পারে। এমনকি সোলার প্যানেলে এই রঙের মাধ্যমে সৌর আলোর শোষণ ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করা সম্ভব।
সামগ্রিকভাবে বলা যায়, যদিও এখনো এই প্রযুক্তি পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে, তবে পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই প্রযুক্তির এই প্লাজমোনিক রং ভবিষ্যতে শিল্প ও প্রযুক্তি জগতে এক নতুন বিপ্লবের সূচনা করতে পারে। তাই এটি এখন শুধু বৈজ্ঞানিক কল্পনার বিষয় নয়—অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এটি হয়ে উঠবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এক অন্যতম হাতিয়ার।
তথ্যসূত্র: University of Central Florida (UCF), New Scientist, Advanced Materials Journal, Never Paint Again Blog, Nature Inspired Nanostructures Research.
সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), শিক্ষক ও লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com