“মানুষ তার মস্তিষ্কের মাত্র ১০% ব্যবহার করে। কিন্তু কি হবে যদি আমরা আমাদের মস্তিষ্কের ১০০% ই ব্যবহার করি?” এই ধারণাটি বহু মানুষের মধ্যে প্রচলিত একটি মিথ। হলিউডের “লুসি”র মতো সিনেমা এই মিথকে আরও ব্যাপক করে তুলেছে। কিন্তু বাস্তবতা কি সত্যিই তাই? বিজ্ঞান কি বলে?
এই ধারণাটি একেবারেই ভুল এবং বিজ্ঞানসম্মত নয়। নিউরোসায়েন্টিস্টরা দীর্ঘদিন ধরেই এই মিথটি ভেঙে দিতে চেষ্টা করছেন। মস্তিষ্কের প্রতিটি অংশেরই নির্দিষ্ট কাজ রয়েছে এবং আমরা প্রতিদিনই আমাদের মস্তিষ্কের প্রায় সকল অংশ ব্যবহার করি।
মিথের উৎপত্তি
এই মিথটির সঠিক উৎপত্তি অস্পষ্ট। তবে ধারণা করা যায় যে, বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম জেমসের কিছু লিখা এই মিথের উদ্ভবের জন্য দায়ী হতে পারে। আরেকটি সম্ভাব্য উৎস হল ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত ডেল কার্নেগির “হাউ টু উইন ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স পিপল” বইয়ে উইলিয়াম জেমসের একটি ভুল ব্যাখ্যা।
বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা এই মিথকে ভুল প্রমাণ করেছে। নিউরোইমেজিং টেকনোলজি, যেমন fMRI এবং PET স্ক্যান, দেখায় যে মস্তিষ্কের সব অংশই সর্বদা সক্রিয় থাকে, এমনকি ঘুমন্ত অবস্থায়ও।
মস্তিষ্কের ক্ষয়-ক্ষতির অধ্যয়ন: মস্তিষ্কের যেকোনো অংশের ক্ষতি শারীরিক ও মানসিক কর্মক্ষমতাকে প্রভাবিত করে।
ব্রেইন স্ক্যান: PET এবং fMRI স্ক্যান দেখায় যে মস্তিষ্কের সব অংশই সবসময় কিছু না কিছু কার্যকলাপে জড়িত থাকে।
শক্তির ব্যবহার: মস্তিষ্ক শরীরের মাত্র ২% ওজন হলেও, এটি শরীরের মোট শক্তির ২০% ব্যবহার করে। যদি ৯০% মস্তিষ্ক অব্যবহৃত থাকত, তাহলে এত বেশি শক্তির প্রয়োজন হত না।
বিবর্তন: বিবর্তনের ধারায়, অব্যবহৃত অঙ্গের ক্ষয় হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। যদি ৯০% মস্তিষ্ক অব্যবহৃত থাকত, তাহলে বিবর্তনের ধারায় এটি আরও ছোট হয়ে যেত।
কোষের কার্যকলাপ: একক-ইউনিট রেকর্ডিং কৌশলের মাধ্যমে মস্তিষ্কের একক কোষের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, প্রতিটি কোষই কিছু না কিছু কার্যকলাপে জড়িত।
সিনাপটিক ছাঁটাই: অব্যবহৃত সিনাপসের (যে সংযোগস্থলে স্নায়ুকোষগুলি একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে) ক্ষয় হওয়ার প্রবণতা থাকে। যদি ৯০% মস্তিষ্ক অব্যবহৃত থাকত, তাহলে মস্তিষ্কে ব্যাপক সিনাপটিক ক্ষয় দেখা যেত।
এই মিথের ফলে অনেকেই তাদের মস্তিষ্কের সম্পূর্ণ ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছে না বলে হতাশায় ভোগে। আসলে আমাদের মস্তিষ্ক অবিশ্বাস্যভাবে শক্তিশালী, এবং আমরা সবাই এর পূর্ণ ক্ষমতা ব্যবহার করার সম্ভাবনা রাখি। শিক্ষা, অনুশীলন এবং নতুন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমরা আমাদের মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে পারি।
অনেকে প্রশ্ন করেন যে, যদি আমরা আমাদের মস্তিষ্কের ১০০% ব্যবহার করি, তাহলে আমাদের কি সুপার পাওয়ার থাকবে না? উত্তর হল না। মস্তিষ্কের ১০০% ব্যবহার করার অর্থ এই নয় যে আমরা কোন অতিমানবীয় ক্ষমতা লাভ করব। বরং এর অর্থ হল আমরা আমাদের মস্তিষ্কের সকল ক্ষমতা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারব, যা আমাদের জীবনে সফলতা অর্জন করতে সাহায্য করবে।
মানুষ তার মস্তিষ্কের মাত্র ১০% ব্যবহার করে, এই ধারণাটি একটি মিথ মাত্র। বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এবং যুক্তির আলোকে এই মিথটি ভুল প্রমাণিত। আমাদের উচিত এই মিথটি বিশ্বাস না করে আমাদের মস্তিষ্কের অপার সম্ভাবনা কে আবিষ্কার করার চেষ্টা করা।
মস্তিষ্ক একটি অত্যন্ত জটিল এবং আশ্চর্যজনক অঙ্গ। এটি ক্রমাগত শিখছে, বিকশিত হচ্ছে এবং নতুন নতুন যোগসূত্র তৈরি করছে। আমাদের উচিত এই অঙ্গের প্রতি যত্নবান হওয়া এবং এর সম্পূর্ণ ক্ষমতা ব্যবহার করে আমাদের জীবনকে সার্থক করা।