১২ সেপ্টেম্বর ছিল বিখ্যাত সুলেখক বিভূতিভূষণের জন্মদিন সে উপলক্ষ্যে পাঠক ও লেখক মাহমুদুল হাসান মৃদুলের লেখা ,
বাংলা সাহিত্যে প্রকৃতি, নান্দনিকতা, নিসর্গ, আর গ্রাম্য জীবনকে কেউ যদি সবচেয়ে নিখুঁতভাবে সাহিত্যে ফুটিয়ে তুলে আনেন, তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। চরিত্রের উপস্থাপন, অতুলনীয় গদ্য আর দৈনন্দিন জীবনকে বাস্তবিকভাবে সাহিত্যে তুলে আনা থেকে ভাষার অপরূপ উপস্থাপন সবকিছু মিলিয়ে তার লেখা বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে বাংলা সাহিত্যে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিঃসন্দেহে বলা যায় প্রকৃতির জীবন শিল্পী। বাংলা কথা সাহিত্যের ব্যাপ্তিতে যার তুলনা পাওয়া ভার।
-আহমাদ ইশতিয়াক
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণার ঘোষপাড়া-মুরারিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব কাটে গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে, যা পরবর্তীতে তার সাহিত্যের মূল প্রেক্ষাপট হিসেবে কাজ করে। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় ব্যারাকপুর মিশনারি স্কুলে এবং পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। লেখালেখি ছাড়াও তিনি শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।
শৈশবকাল থেকেই গ্রাম-বাংলার অপরূপ প্রকৃতি তাঁকে মুগ্ধ করত। ঠিক সে কারণেই তিনি তাঁর লেখায় বারবার প্রকৃতিকে ধরার চেষ্টা করেছেন এবং সফল হয়েছেন। প্রকৃতির পাশাপাশি তাঁর রচনায় গ্রাম-বাংলার দুঃখ, দারিদ্র্য, স্বপ্ন, আশা-এ সকল বিষয়ের ছাপ স্পষ্ট।
১৯২২ সালে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় বিভূতিভূষণের প্রথম গল্প ‘উপেক্ষিতা’ প্রকাশিত হয়। ওই বছর শ্রেষ্ঠ গল্প ক্যাটাগরিতে গল্পটি শ্রেষ্ঠ গল্পের মর্যাদাও পায়।
মাত্র ২১ বছরের সাহিত্যজীবনে তিনি পাঠকদের উপহার দিয়েছেন বহু উপন্যাস, ছোটগল্প, দিনলিপি শিশুসাহিত্য এবং ভ্রমণকাহিনি।
বিভূতিভূষণের সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা হলো ১৯২৯ সালে প্রকাশিত তার প্রথম উপন্যাস "পথের পাঁচালী", যা বাঙালি জীবনধারার এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। এই উপন্যাসটি পরবর্তীকালে সত্যজিৎ রায়ের হাতে চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয় এবং বিশ্বব্যাপী প্রশংসা লাভ করে। "পথের পাঁচালী" উপন্যাসের মাধ্যমে অপু ও দুর্গার জীবনের কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে, যা বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি হিসেবে স্বীকৃত।১৯২৫ সালে তিনি পথের পাঁচালী রচনা শুরু করেন এবং শেষ করেন ১৯২৮ সালে। তার অন্যান্য বিখ্যাত রচনার মধ্যে রয়েছে:অপরাজিত (পথের পাঁচালীর দ্বিতীয় পর্ব বা সিক্যুয়েল),মেঘমল্লার,চাঁদের পাহাড়,আদর্শ হিন্দু হোটেল,আরণ্যক,মরণের ডঙ্কা বাজে,হীরামানিক জ্বলে,ইছামতী ইত্যাদি।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত উপন্যাসসমূহের পাশাপাশি তাঁর ছোটগল্পগুলোও পাঠক মহলে বিশেষভাবে সমাদৃত। সেকালের রীতিনীতি, বিচার-আচার, শিল্প-সংস্কৃতি, মানুষ ও প্রকৃতির অভিন্ন সম্পর্ক, গ্রামবাংলা, ভৌতিক রহস্য-এসকল বিষয়ের দেখা মিলবে তাঁর ছোটগল্পে।
তাঁর অতিপ্রাকৃত গল্পের উপাদানও বিচিত্র। সেসব গল্পে থাকে অলৌকিকতা, ছায়ামূর্তি, প্রেতাত্মা কিংবা তন্ত্র-মন্ত্র। গল্পের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকে অপার্থিব আতঙ্ক। সেই সাথে রয়েছে তাঁর গ্রাম বাংলাকে দেখার এক অপরূপ চোখ। সেই চোখে মূর্ত হয়ে ওঠে বিমূর্ত অশরীরীরাও!এজন্যই বাংলাদেশ অতিপ্রাকৃত সাহিত্যের অন্যতম মূল্যবান সম্পদ মনে করা হয় এই গল্প গুলোকে।
আগেই বলেছি বিভূতিভূষণের লেখায় প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক বিশেষভাবে ফুটে ওঠে। তার গল্পের চরিত্রগুলো সাধারণ মানুষ হলেও তাদের জীবনের আনন্দ-বেদনা, সংগ্রাম ও প্রেম অত্যন্ত মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপিত হয়। বিভূতিভূষণের ভাষা সহজ ও সাবলীল, যা পাঠকদের মনের গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম।এজন্য তিনি আমার ও প্রিয় লেখকদের তালিকায় শীর্ষে জায়গা করে নিয়েছেন।
চাঁদের পাহাড়, আরণ্যক, পথের পাঁচালীর মতো লেখা যদি বাংলা সাহিত্য না আসতো তবে হয়তো বাংলা সাহিত্য কখনোই পূর্ণতা পেতো না।এগুলো আমার এবং আমাদের অত্যন্ত প্রিয় বই।
আজ ১২ সেপ্টেম্বর।এই অমর এবং নন্দিত বাঙালি কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১৩০তম জন্মদিন।শুভ জন্মদিন প্রিয় লেখক