বাংলাদেশের সবচেয়ে সেরা ও ব্যতিক্রমী উন্মুক্ত ব্লগিং ফোরাম ই-নলেজ আইডিয়ায় আপনাকে সুস্বাগতম।জ্ঞান চর্চার এই প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্লগিং, লেখালেখি, আলোচনা, মতামত, ব্যাখ্যা, টিউটোরিয়াল তৈরি ইত্যাদি কার্যক্রম করে অবদান রাখতে পারবেন।জ্ঞানীদের আলোচনার কেন্দ্রে নিজেকে বিকাশিত করার পাশাপাশি কার্যক্রমে সম্মানের প্রতীক পয়েন্ট,ব্যাজ অর্জনের সুযোগ তো থাকছেই, আরও রয়েছে আইডিয়া গুরু খেতাব অর্জনের সুযোগ।এছাড়াও সেরাদের উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে আকর্ষণীয় পুরষ্কার প্রদান কার্যক্রমের ছোয়া তো রয়েছই বাংলাদেশের সবচেয়ে সেরা ও ব্যতিক্রমী এই প্ল্যাটফর্ম এ।আজই যোগ দিন!নিবন্ধন করতে এখানে ক্লিক করুন...।

ছোটোগল্প: সেলভি

0 পছন্দ 0 অপছন্দ
42 বার প্রদর্শিত
করেছেন (120 পয়েন্ট) "ছোটগল্প" বিভাগে লেখা প্রকাশিত

প্রতিটি সংগীতানুষ্ঠানের শেষে স্বাক্ষর সংগ্রহকারীরা সেলভিকে (Selvi) এমনভাবে ঘিরে থাকত যে তাঁকে মঞ্চ ছেড়ে আসতেই দিত না। সেই মুহূর্তে মোহন এগিয়ে আসত সেলভিকে উদ্ধার করতে এবং হল থেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, যাতে সে ট্রেন ধরতে পারে।


মোহনের আদেশের বিরোধিতা করা সেলভির অভ্যাস ছিল না যদিও হাতে তখন যথেষ্ট সময় ছিল। সেলভির উপর কর্তৃত্ব ফলাবার এটা ছিল মোহনের সুবর্ণ সুযোগ। স্তাবকদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য সে মন্তব্য করত যদি সে গাড়ীতে কোন মতে বসতে পারে তাহলে সমস্ত অটোগ্রাফের (স্বাক্ষরের) খাতা ভর্তি করে দেবে কারণ সময়ের ব্যাপারে ও বড় দায়িত্বজ্ঞানহীন।


জনতা তাকে এক স্বর্গীয় সত্তারূপে মনে করত। কিন্তু তার মুখমণ্ডল যেন তার (মোহনের) একান্ত নিজস্ব ছিল। তার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকারে তার মনে হয়েছিল সে দেখতে মন্দ নয় তবে উন্নতি সাধন দরকার। তার গায়ের রং ছিল মোটামুটি। কিন্তু সে তার জন্য উপযুক্ত ক্রীম এবং ট্যালকমের ব্যবস্থা করেছিল। মোহন চাইত। না যে কেউ তাকে এই সন্দেহ করুক যে, সে প্রসাধনী দ্রব্য ব্যবহারে তাকে (সেলভিকে) উৎসাহ যোগায়। মহাত্মা গান্ধীর একজন অনুগামী হওয়ার জন্য সে সাদাসিধে পোশাক পরত এবং বিলাসিতা এড়িয়ে চলত ও নিজের স্ত্রীর ব্যক্তিত্ব বাড়াবার জন্য আধুনিক কৃত্রিম সহায়তা সে আকাঙ্ক্ষা করত না। কিন্তু সে সিঙ্গ পুরে সেলভির একজন খুব অনুরক্ত ভক্তকে আবিষ্কার করেছিল যে সকলের অগোচরে নিয়মিত প্রসাধনী দ্রব্য পাঠাত।


সেলভি যখন মঞ্চে আবির্ভূত হত তখন জনতার আলোচনার বিষয় হত তার চামড়ার প্রকৃত রং কিরূপ। সেলভির জীবনের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে তার ভক্তদের মধ্যে চর্চা হত বিশেষ করে এটা চলত বোর্ডলেস রেস্তোরাঁয় কফি পান করতে করতে। মালিক ভার্মা এই আলোচনা আড়ি পেতে শুনতে ভালবাসত কারণ সে ছিল তার অন্যতম উপাসক—অবশ্য দূর থেকে। সে প্রায়ই ভাবত দেবী লক্ষ্মী তাকে অনুগ্রহ করেছেন প্রচুর ধনসম্পদ দিয়ে। কিন্তু তার আকাঙ্ক্ষা ছিল দেবী সরস্বতীর অনুগ্রহ পাবার যে দেবী হলেন মানবীরূপে ঐশ্বরিক গায়িকা সেলভি।


হাজার হাজার মানুষের মত ভার্মারও খুব ইচ্ছে হত তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যে নাকি সুরক্ষিত দুর্গের অদৃশ্য দেওয়ালের মধ্যে বাস করত। তার (মোহনের) অনুপস্থিতিতে সে (সেলভি) কখনও কাউকে মোহনের সঙ্গে তার বিবাহের কথা বলেনি।


তার দর্শনাকাঙ্ক্ষী বিরাট সংখ্যক দর্শকদের মধ্যে খুব কম লোকই তার দেখা পেত। বাড়ির বিভিন্ন স্থানে তাদের অভ্যর্থনা জানানো হত কিন্তু কেউই মোহনের সেক্রেটারী বা তার সেক্রেটারীর সেক্রেটারী ছাড়া সেলভিকে এক পলকের জন্যও দেখতে পেত না। নির্বাচিত ব্যক্তিত্বদের প্রধান হলঘরে সাদর অভ্যর্থনা জানানো হত এবং সোফাতে বসানো হত। সাধারণ দর্শনার্থীদের আসন দেওয়া হত না। যতক্ষণ তাদের ধৈর্য থাকত ততক্ষণ অপেক্ষা করে তারা চলে যেত।


তাদের বাসভবনটি ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলের বিশাল দালানবাড়ি এবং এটি ছিল স্যার ফ্রেডারিক লওলের বাসভবন। বাড়িটি ছিল দোতলা, তাতে ছিল অতি বৃহৎ ছয়টি হলঘর, উঁচু উঁচু দরজা, ভেনেসীয় খড়খড়িযুক্ত গথিক শৈলীতে নির্মিত জানালা; আর এটি কয়েক একর জমির উপর শহর থেকে পাঁচমাইল দূরে মেম্পি পাহাড়ের উপর স্থাপিত হয়েছিল। জায়গাটিতে বড় বড় গাছের বাগান ছিল। বিশেষ করে গেটের সামনে ছিল একটা এম্ গাছ যার বীজ আনা হয়েছিল ইংল্যান্ড থেকে। কেউই আগে বাড়িটি ভাড়া নিত না এই ভয়ে যে ফ্রেডারিকের আত্মা নাকি ওখানে থাকে এবং তার প্রেতাত্মা নিয়ে অনেক গল্প সেইসময় মালগুড়ি শহরে চালু ছিল। এই পরিত্যক্ত বাড়িটি মোহনের মনোযোগ আকর্ষণ করল এবং প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে বাড়িটি পাবার চেষ্টা করল। সে বলল যে গান্ধীজীর অহিংস আন্দোলন ব্রিটিশদের ভারত ছাড়তে বাধ্য করেছিল সুতরাং গান্ধীজীর একজন নিরহঙ্কার অনুগামী হয়ে ঐ একই প্রক্রিয়ায় অন্তত একজন ব্রিটিশ ভূতকে সে বাড়ি থেকে তাড়াবে। সে বাড়িটি কেনার টাকা জোগাড় করেছিল সেলভির কণ্ঠস্বর একজন চিত্রতারকাকে ধার দিয়ে যে একটি চলচ্চিত্রে সেলভির গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার ঠোঁট নেড়েছিল এবং যথেষ্ট খ্যাতিলাভ করেছিল। এরপর মোহন সমস্ত রকম চলচ্চিত্রে সুযোগদানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল সেলভিকে তার নিজস্ব অনন্য ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপে প্রতিষ্ঠা করবে বলে। একটু একটু করে প্রচার এবং সুপারিশ দ্বারা প্রত্যেক সাংবাদিক এবং সংগীত সমালোচকদের আনুকূল্য লাভ করে সে তার ভাবমূর্তি বর্তমানকালের গৌরবান্বিত অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত করেছিল। বছরের পর বছর ধরে তার কঠোর শ্রমের ফলে সেলভির নাম এক যাদুময় মুগ্ধতা লাভ করল। প্রত্যেকটি পত্রপত্রিকায় তার ছবি প্রকাশিত হতে লাগল। তার চাহিদা এত বেশি ছিল যে মোহনের অফিসটি দেশের সমস্ত অঞ্চল থেকে আগত সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজকদের ভিড়ে ভর্তি থাকত। সে কাউকে কথা দিত না কিন্তু তাদের অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে দিত এবং কতকগুলি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করত সেলভির সমমর্যাদা বজায় রাখার জন্য। যখন সে কোন কৃতজ্ঞ আবেদনকারীর আবেদন গ্রহণ করত সে তখন উচ্চ পারিশ্রমের অর্ধেকটা বিনা রসিদে গ্রহণ করত। মাঝে মাঝেই সে তার কৌশল পরিবর্তন করত এবং সে স্পষ্ট করে বলত যে একটি বিশেষ সংগীতানুষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত অর্থ কোন এক সমাজসেবামূলক সংগঠনের তহবিলে জমা হবে যার পৃষ্ঠপোষকরা সুপরিচিত। সে আপাতদৃষ্টিতে কোন পারিশ্রমিক গ্রহণ করত না বটে, কিন্তু নগদ অর্থে খরচাপাতি দাবি করত যা তার স্বাভাবিক পারিশ্রমিকের আসন্নমানের সমান। সে অর্থসংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিল, সে জানত কেমনভাবে টাকা উপার্জন করতে হয় এবং একই সঙ্গে আয়কর ফাঁকি দিতে হয়। তার মন সর্বদা ব্যস্ত থাকত কিভাবে পুরুষ ও মহিলাদের সংগঠিত করতে হবে সেই পরিকল্পনায়। ইতিমধ্যে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ত তার স্টেনোগ্রাফারকে নিয়ে এবং টেলিফোনে কথাবার্তায়।


পেশাগত ব্যাপারের সঙ্গে সে জনসংযোগের উপরও নজর রাখত। কখনও কখনও বাছাই করা পার্টিতে উপস্থিত হত এবং বিশিষ্ট অতিথিদের ভোজে আমন্ত্রণ জানাত যাদের মধ্যে আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বও উপস্থিত থাকত।


তার দেওয়ালে টাঙানো ছিল তার নিজস্ব ও সেলভির ফটো, তাদের সঙ্গে থাকত পৃথিবীর বিভিন্ন ক্ষেত্রে নামকরা ব্যক্তিত্বের ছবিও।


বোর্ডলেস রেস্তোরাঁয় কথাবার্তার টেবিলের আলোচনা থেকে ভার্মা শুনেছিল যে বিনায়ক মুদালী স্ট্রীটের একটি পেছনের গলিতে একটি ছোট জীর্ণ টালির বাড়িতে সেলভির মা যার হাতে যথেষ্ট নগদ অর্থ ছিল না, সেলভি ও তার ভাইবোনদের যন্ত্রের সহযোগিতায় সঙ্গীত শিক্ষা দিত।


সেলভি সংগীত প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিল তাই স্কুল ম্যাগাজিনের জন্য ছবি তোলাতে তার মা মার্কেট রোডে মোহনের ফটো স্টুডিওতে এসেছিল। তারপর থেকে মোহন তাদের একজন শুভাকাঙ্ক্ষীরূপে তাদের বাড়িতে যেত এবং এমন ভাব দেখাত যে সে যেন ঐ পরিবারের একজন সদাশয় দেবতা। কখনও কখনও সে সেলভির গান শুনত এবং নাটকীয়ভাবে মেঝের উপর এক পায়ের উপর আর এক পা আড়াআড়ি করে রেখে বসত এবং গভীর মনোনিবেশ সহকারে তার গান শুনত এমন ভঙ্গিতে যে সে যেন বোঝাতে চাইত যে এইরকম একজন প্রেরণাময়ী শিল্পীর উপস্থিতিতে উচ্চস্থানে চেয়ারে বসে থাকা তার পক্ষে নিন্দনীয়।


দিনের পর দিন মোহন পরিবারটির উপর কর্তৃত্বের ভার নিল। বোর্ডলেস রেস্তোরাঁয় কেউই নিশ্চয় করে বলতে পারল না কোথায়, কিভাবে এবং কখন মোহনের সঙ্গে সেলভির বিয়ে হয়েছিল।


বড় বড় হলঘর পেরিয়ে যেতে যেতে যখন তার মা ও ভাইবোনেরা উত্তেজিত ভাবে বাড়িটির মাত্রা দেখতে লাগল তখন সেলভি কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল না। সে বাড়িটির মধ্যে দিয়ে এমনভাবে যেতে লাগল যেন কোন যাদুঘরের দরদালান দিয়ে যাচ্ছে। হতাশ হয়ে মোহন তাকে জিজ্ঞাসা করল জায়গাটা তার কেমন লাগছে। সে সহজভাবে উত্তর দিল, 'বেশ বড় দেখাচ্ছে'। পরে সে বাড়িটির বর্ণনা দিল এবং এর ইতিহাস বলল। সে কোন আকর্ষণ অনুভব না করে শুনতে লাগল। তারা যে গদিওয়ালা প্রকাণ্ড বেঞ্চগুলির উপর বসেছিল সেগুলি কোম্পানীর আমলের এবং তারা সেগুলি ফেলে গিয়েছিল। সে যে আরামকেদারায় বসেছিল তার বিশালতার দিকেও তার কোন দৃষ্টি ছিল না। পরবর্তীকালে শত শত সংগীতানুষ্ঠানের সময় ভ্রমণকালে সে উপলব্ধি করল যে সেলভি তার পারিপার্শ্বিক জগৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। তার কাছে প্রাসাদোপম ভবন কিম্বা বিলাসবহুল পাঁচতারা হোটেল, ছোট শহর বা গ্রামের বাড়ি যেখানে সুবিধা কম সবই সমান আকর্ষণীয় ছিল। সর্বত্রই সংগীতানুষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ে সে প্রস্তুত হয়ে থাকত। কোথায় তাকে গাইতে হবে এবং কত পারিশ্রমিক সে পাবে সে ব্যাপারে সে সর্বদা উদাসীন ছিল। কোন ব্যাপারে সে কৌতূহলী ছিল না বরং অনিশ্চিত অদৃষ্টের জন্য সে সর্বদাই প্রস্তুত থাকত। নির্দাবী, অকৌতূহলী অভিযোগহীন সেলভিকে দেখে মনে হত সে যেন সবকিছুর প্রতি উদাসীন থেকে বেঁচে আছে।


পঁচিশ বছরের মধ্যে সে সংগীতের দেবীরূপে একজন জাতীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিল। যখন পরিপূর্ণ হলঘরে তার নাম ঘোষণা করা হত তখন আসন দখলের জন্য শ্রোতাদের মধ্যে হৈ-হল্লা ও মারামারি লেগে যেত। শ্রোতৃমণ্ডলীর মধ্যে রোমাঞ্চ ও বজ্রনির্ঘোষ জয়ধ্বনি উঠত। যে মুহূর্তে সে ধীরে ধীরে গলা পরিষ্কার করে যন্ত্রসহযোগীদের যন্ত্রপাতির সুরের সঙ্গে গুনগুন করত তখন শ্রোতারা নিঃস্তব্ধতার মধ্যে নিজেদের হারিয়ে ফেলত। তার কণ্ঠস্বর এমনই স্বাচ্ছন্দ ছিল যে সকলশ্রেণীর শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে যেত—এমনই ছিল তার সংগীতের আবেদন। এমনকি যারা সংগীতের পরোয়া করত না তারাও আত্মমর্যাদার খাতিরে তার গান শুনত।


যেখানেই তার (সেলভির) সংগীতানুষ্ঠান হোক না কেন সেখানকার হলে মোহন প্রথম সারির কেন্দ্রীয় আসনটি অধিকার করে থাকত এবং গায়িকার দিকে এমন নিশ্চল দৃষ্টি নিবন্ধ করে থাকত যে লোকেরা অবাক হয়ে ভাবত যে সেকি যাদুতে বিমোহিত হয়ে আছে নাকি তাকে প্রেরণা দিচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে তার মন ব্যস্ত থাকত অর্থসংক্রান্ত সমস্যায়, সে লক্ষ্য করত কোন টেপরেকর্ডার কেউ চোরাচালান করে হলের ভেতরে নিয়ে এসেছে কিনা এবং এটাও লক্ষ্য করত তার আশেপাশের ভি.আই.পি-দের প্রতিক্রিয়া।


প্রতিটি সংগীতানুষ্ঠানের পরিকল্পনা রচনা করার সময় সে সেলভির সঙ্গে বসত এবং তাকে দৃঢ়ভাবে জিজ্ঞাসা করত যে সে কল্যাণী ভার্নাম দিয়ে শুরু করবে কিনা কিন্তু সে জীবনে 'হ্যাঁ' ছাড়া আর কোন শব্দ উচ্চারণ করত না। সে তার কাছে প্রস্তাব রাখত কোন রাগটি বিস্তার করবে না এবং কোন রাগটি একটু সংক্ষেপে গাইবে। তাকে এমন স্বাধীনতা দেওয়া হত যা প্রকৃতপক্ষে অর্থহীন কেননা অনুষ্ঠান এমনভাবে সাজানো হত যে সংগীতানুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত সময়ে তার ইচ্ছেমত কিছু করার উপায় ছিল না। সে এই ভেবে গর্ববোধ করত যে তার পরিকল্পনা এবং পরিচালনা ছাড়া সে সবকিছু ভেস্তে দিতে পারত কিন্তু সে কথা কেউ উপলব্ধি করতে পারত না।


প্রত্যেকে মোহনকে তোষামোদ করত এই আশায় যে সে তাদের তারকার সান্নিধ্যে নিয়ে যাবে। মোহন একটি বিশেষ শ্রেণীর লোকদের তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে উৎসাহ দিত এবং তাকে (সেলভিকে) বোঝাতে চেষ্টা করত যে বড় বড় ব্যক্তিত্ব যেমন মন্ত্রী, পুলিশের আই.জি, একজন ম্যানেজিং ডিরেক্টর অথবা সংবাদপত্রের সম্পাদক তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। তারাও মোহনকে কিছু আনুকূল্য দেখাতে আগ্রহ প্রকাশ করত এই আশায় যে পরিবারের বিশেষ একজন বন্ধু হিসেবে সেলভির কাছ থেকে তারা স্বীকৃতি পাবে। দশ মিনিট পর সেলভি বেরিয়ে আসত এবং খুব সংক্ষেপে তাদের অভ্যর্থনা জানাত আর দর্শনার্থীরা তার সর্বশেষ অনুষ্ঠানের প্রসঙ্গ টেনে এনে "কে প্রশংসা করতে শুরু করত। এই ধরনের প্রশংসার জবাবে সে উপযুক্ত লাইনগুলি ব্যক্ত করত মাত্র। মোহন এই ভেবে পরিতৃপ্তি লাভ করত যে তার শেখানো কথা, ভঙ্গি এবং বাচনভঙ্গি যথাযথভাবে সেলভি পেশ করেছে। সে আত্মতৃপ্তি লাভ করত এই ভেবে যে বিনায়ক মুদালী স্ট্রীটের এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সন্তানের পরিবর্তে তাকে একজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের রূপ দিতে পেরেছে। সে নিজেকে ধন্যবাদ দিত এই দেখে যে বিনায়ক মুদালী স্ট্রীটের সংক্রমণ থেকে সেলভি বের হতে পেরেছে এবং তাকে তার আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা গেছে। কালক্রমে সেলভি তার পরিবারের কাছে দুর্লভ বস্তু হয়ে উঠল এবং জনগণের সঙ্গে কাজকর্ম বেড়ে যাওয়ায় তার মা এবং অন্যান্যরা তার জীবন থেকে ম্লান হয়ে যেতে লাগল। সেলভি কয়েকবার তার মায়ের সম্পর্কে তাকে বলতে গিয়েছিল কিন্তু মোহন বিরক্ত হওয়ায় সে চিরকালের মত নীরব হয়ে গেল এই ব্যাপারে।


যখন এই ধরনের উপলক্ষ আসত সেলভি তাকে মায়ের কথা মনে করিয়ে দিত কিন্তু মোহন বিরক্তি প্রকাশ করে বলত পরের দিন রাজ্যপালকে মধ্যাহ্ন ভোজনে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে এবং সেখানে তাকে গান গাইতে হবে, তবে প্রথাগতভাবে নয়, কেবলমাত্র ত্রিশ মিনিটের জন্য। যদি সেলভি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করত তারপর দিন কি হবে তখন মোহন তাকে অগ্রাহ্য করে টেলিফোনে কথা বলার জন্য ঐ স্থান ছেড়ে চলে যেত। সেলভি তার কৌশল বুঝতে পেরে নিজেকে সংযত করে ফেলত। সে গোপন মানসিক যন্ত্রণায় কেবল ভাবত যে তার নিজের মা-ই তাকে দেখতে পায় না, তার মানসিক কষ্টের কথা শোনার মত কেউ ছিল না।


মোহন যখন দেখল সে সেলভি তার মায়ের সম্বন্ধে মোহমুক্ত হয়েছে তখন সে খুব খুশী হল। সে যেভাবে তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে সেজন্য সে নিজেকে ধন্যবাদ দিত।


এইভাবে মাস গেল, বছর গেল। সেলভি একটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মত তার জীবন অতিবাহিত করতে লাগল।


যখন তারা কলকাতায় তখন সে সেলভির মায়ের মৃত্যু সংবাদ গেল। এই সংবাদ পেয়ে সেলভি তার সব কর্মসূচী বাতিল করতে বলল। মোহন তাকে সান্ত্বনা দিতে এসে যখন তার কষ্টের চেহারাটা দেখল তখন সে সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিল। ফিরতি ট্রেন ভ্রমণের সময় সে (সেলভি) সারাটা পথ চুপ করে রইল, মোহন তাকে একটা কথাও বলাতে পারল না। যদিও সেলভি নীরব প্রকৃতির ছিল তবু কেউ যদি তার সঙ্গে কথা বলত সে অন্ততঃপক্ষে এক অক্ষর বিশিষ্ট মন্তব্য করে উত্তর দিত। একটানা ছত্রিশ ঘণ্টা ভ্রমণকালে সে না বলল একটা কথা, না তাকাল তার দিকে ফিরে। বাড়ি পৌঁছেই মৃতাকে সম্মান দেখাবার জন্য সেলভিকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে গেল এই ধারণা করে যে সেলভি তাকে প্রশংসা করবে। তার বড় গাড়ি এবং সে নিজেও সেখানকার পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে বে-মানান ছিল এবং সে সেলভির মায়ের বাড়িতে গেল। সেলভির বোন এবং ভাই আসেনি। একজন প্রতিবেশী কিভাবে তার মৃত্যু হল এবং কিভাবে তার মৃতদেহ রাখা হয়েছে তার বিস্তৃত তথ্য ব্যাখ্যা করল।


এমন এক বিখ্যাত তারকার কাছ থেকে তাকে মোহন সরিয়ে দেবার চেষ্টা করল। সেলভি যখন মোহনকে ফিরে যেতে বলল এবং সে সেখানে থাকার কথা বলল তখন মোহন অবাক হয়ে গেল। মোহন দ্বিধাগ্রস্তভাবে বিড়বিড় করে বলল যে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে গাড়িটাকে ফেরৎ পাঠাবে কিন্তু সেলভি তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল।


মোহন একথার বিরোধিতা করার চেষ্টা করল কিন্তু সেলভি অকপটে জানাল যে তার মা, যিনি তার গুরু এখানেই বাস করতেন এবং এখানেই মারা গেছেন এবং সেও তাই করবে কারণ তার মায়ের পক্ষে যেটা ভাল সেটা তার পক্ষেও ভাল।


মোহনের কাছে এটা অজানা ছিল যে সর্বদা শান্ত এবং সৌজন্যপূর্ণ সেলভি এমন নিষ্ঠুর অথবা বাকপটু হতে পারে। সে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল এই ভেবে যে সেলভির মনোভাবের পরিবর্তন হতে পারে। সেই প্রতিবেশীটি বৃদ্ধা মহিলার শেষ মুহূর্তগুলির এবং শেষ কাজ করার সময় যে সমস্যা দেখা দিয়েছিল তার খুঁটিনাটি বর্ণনা করতে লাগল। সে জানাল কিভাবে সে সেলভির কাছে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছিল এবং শেষপর্যন্ত সরযূ নদীর তীরে কিভাবে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছিল। সে স্মৃতিচারণ করে বলল যে, সে তার বাল্যকাল থেকেই সেই বৃদ্ধা মহিলাকে জানে-সে তাকে 'আন্টি' বলে ডাকত এবং মন দিয়ে সেলভির গানের রেওয়াজ শুনত, কিন্তু এখন সে সেলভির গান শোনার জন্য হলে প্রবেশ করার টিকিট কিনতে পারে না।


আতঙ্কিত মোহন আগে কখনও জানতে পারেনি যে সেলভি তার লিখিত ভাষ্য ছাড়া আর কিছু বলতে পারে। তার সংকেত পাওয়ার পর সেলভি কখনও কাউকে তার সঙ্গে কথা বলার সময় দিত না। সেদিন সে বিশ্বাসই করতে পারল না যে সেলভি তার সংকেতকে অগ্রাহ্য করল এবং সেই লোকটির কাছ থেকে শেষকৃত্যের প্রচণ্ড উত্তেজনাময় বর্ণনা মন দিয়ে শুনতে লাগল বিজয়ের আনন্দে।


অধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করার পর যাওয়ার আগে মোহন জানতে চাইল তার কিছু দরকার আছে কিনা কিন্তু সেলভি দৃঢ়ভাবে বলল তার কিছু দরকার নেই। সে একটা পুরোনো শাড়ি পড়েছিল-কোন মেক-আপ সে নেয়নি এবং গহনাও পরেনি। মোহন জানত যে তার কোন কিছুরই প্রয়োজন নেই। এই প্রথম সে তার সঙ্গে অনেকগুলি সংগীতানুষ্ঠান সম্বন্ধে আলোচনা করার চেষ্টা করল কিন্তু এই ধরনের প্রশ্নে সে নিজেকে সরিয়ে রাখল। যে গাড়ি চালিয়ে সে এসেছিল সেদিকে জনসাধারণের দৃষ্টি আকৃষ্ট হল না। জনতার দৃষ্টি ঘুরে গেছে সেলভির দিকে যার বিলাসিতা এখন আর নেই, সে এখন আর জনশ্রুতি বা কাহিনী নয়। সে মাকে সাহায্য করতে কখনও আসেনি—একথা শুনে ভেঙে পড়ল।


তিনদিন বাদে মোহন তাকে জানাতে এল যে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে একটি সাম্মানিক ডিগ্রীতে ভূষিত করবে এবং প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন কিন্তু সেলভি অসম্মতি জানাল। চাপাচাপি করাতে সে কারুর সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকৃত হল।


মোহন তাকে অনুষ্ঠানে একবার উপস্থিত হবার জন্য অনুরোধ জানালো এবং সে যে গ্রামোফোনে রেকর্ড করার জন্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল সে কথা বলল। তার ভঙ্গিতে প্রকাশ পেল যে সেগুলি তার ব্যাপার নয়। সে সেলভিকে দোষ দেবার চেষ্টা করল এই বলে যে সে তাকে বিপদে ফেলছে। এককক্ষ বিশিষ্ট বাড়িতে যখন জনতার ভিড় তাদের আলোচনার প্রতিটি কথা লক্ষ্য করছিল এবং অনুসরণ করছিল তখন আলোচনা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছিল কারণ তার মনে হল তার (সেলভির) সাথে কিছু গোপনীয়তা থাকা দরকার। সে ভাবল তাকে যদি একা পেত তাহলে সে হয় তাকে মিষ্টি কথায় ভোলাত নয়ত তার ঘাড় মটকে দিত কিন্তু তা করতে না পারায় সে মরিয়া হয়ে চলে গেল। এক সপ্তাহ বাদে সে আবার তার সঙ্গে দেখা করতে এল কিন্তু সেলভি তাকে অভ্যর্থনাও জানাল না, আবার চলে যেতেও বলল না। মোহন তাকে গাড়িতে উঠে আসার আমন্ত্রণ জানালে সে তা প্রত্যাখ্যান করল। সেলভি মনে মনে তাকে দোষী ভাবল তার জীবন নষ্ট করার জন্য।


তার সঙ্গে পুনরায় দেখা করার আগে মোহন তাকে শোক পালন করবার জন্য আরও চার সপ্তাহ সময় দিল এবং এসে দেখল যে বাড়ির পেছনের ছোট হল ঘরটায় বসে সে গান গাইছে এবং বিরাট জনতা যা বাড়ি ছাড়িয়ে রাস্তায় উপচে পড়ছে তার সামনে গান শুনছে। জায়গাটা যেন একটা অডিটোরিয়াম যেখানে একজন বেহালাবাদক এবং একজন ঢোলবাদক তাকে সহযোগিতা করছে। সে ভাবল সে (সেলভি) তার প্রতিভাকে ক্ষয় করে ফেলছে। সেলভি তাকে বসতে বলল। কিছুক্ষণ এককোণে বসে থেকে সে সন্তর্পণে চলে গেল। সে বার বার তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে কিন্তু সব সময়ই লোকে তাকে ঘিরে থাকে। নানা জায়গা থেকে লোকে বিনা পয়সায় তার গান শোনার জন্য ভিড় জমাত। বোর্ডলেস রেস্তোরাঁর ভার্মাও একটা গিল্টি করা কাগজ দিয়ে মোড়া মিষ্টির বাক্স তাকে উপহার দিয়ে তার মনের বাসনা পূর্ণ করল। সে চিন্তায় নিমগ্ন থাকত এবং কোন কিছু ভ্রূক্ষেপ করত না।


মোহন আশা করেছিল যে রাত্রে তাকে একাকী পেতে পারে। একদিন রাত্রি এগারটার সময়ে মার্কেট রোডে তার গাড়িটা রেখে মোহন বিনায়ক মুদালী স্ট্রীটে হেঁটে এল। সে সেলভিকে ডেকে দরজা খুলতে অনুরোধ করল। সে জানালার একটা ঘুলঘুলি খুলে তাকে চলে যেতে বলল। মোহন হতাশা নিয়ে ফিরে গেল সেলভিকে অকৃতজ্ঞ বদমাশ বলে।

ব্লগ পরিচিতি- ছোটোগল্প: সেলভি

এই ব্লগটির প্রতিক্রিয়া দিতে দয়া করে প্রবেশ কিংবা নিবন্ধন করুন ।

এ সম্পর্কিত কোন ব্লগ খুঁজে পাওয়া গেল না

ই-নলেজ আইডিয়া ফোরামে আপনাকে সুস্বাগতম।জ্ঞান চর্চার অনন্য এই প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্লগিং, লেখালেখি, আলোচনা, মতামত, ব্যাখ্যা, টিউটোরিয়াল তৈরি ইত্যাদি কার্যক্রম করে অবদান রাখতে পারবেন।জ্ঞানীদের আলোচনার কেন্দ্রে নিজেকে বিকাশিত করার পাশাপাশি কার্যক্রমে সম্মানের প্রতীক পয়েন্ট,ব্যাজ অর্জনের সুযোগ তো থাকছেই, আরও রয়েছে আইডিয়া গুরু খেতাব অর্জনের সুযোগ।এছাড়াও সেরাদের উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে আকর্ষণীয় পুরষ্কার প্রদান কার্যক্রমের ছোয়া তো রয়েছই বাংলাদেশের সবচেয়ে সেরা ও ব্যতিক্রমী এই প্ল্যাটফর্ম এ।জ্ঞানার্জনের এই প্ল্যাটফর্মই হোক আপনার লেখালেখি ও জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দু।

    এই মাসে এ পর্যন্ত আইডিয়া গুরু হিসেবে কেউ মনোনীত হননি!

    ...